যাকাতের বর্তমান নিসাব।

লেখকঃ আব্দুল্লাহ আল মাছুম।

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। যাকাত ইসলামের মৌলিক বিধান সমূহের অন্যতম। ইসলামের রোকন সমূহের একটি গুরুত্বপূর্ণ রুকন। পবিত্র কুরআনে নামাযের হুকুমের পাশাপাশি যাকাত আদায়েরও নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। যেমন, কুরআন মাজীদে এসেছে, (তর্জমা)“ তোমরা নামায কায়েম কর,যাকাত প্রদান কর এবং আল্লাহ ( তাআলার দ্বীন)কে আঁকড়ে ধর”- (সূরা হজ্ব : ৭৮)

যাকাত না আদায়ে পরকালীন শাস্তি খুবই ভয়াবহ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, (তর্জমা) “ যারা স্বর্ণ ও রোপৗ জমা করে রাখে , আল্লাহর পথে ব্যয় করে না,তাদেরকে আপনি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দিন। যে দিন তাদের সম্পদগুলো উত্তপ্ত করে তা দ্বারা তাদের মুখমন্ডল,পার্শ্ব ও পিঠে দাগ দেয়া হবে। এবং বলা হবে, এগুলো তোমাদের সেই সম্পদ,যা তোমরা নিজেদের জন্য কুক্ষিগত করে রেখেছিলে। এখন তোমরা নিজেদের অর্জিত সম্পদের স্বাদ আস্বাদন করা।” – (সূরা তাওবা ” ৩৪-৩৫)

অতএব প্রত্যেক মুসলিমের জন্য জরুরী হল, নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে যাকাত আদায়ে যত্মবান হওয়া এবং সঠিক পন্থায় যাকাত আদায় করা।

সঠিক পন্থায় যাকাত আদায়ের জন্য তিনটি বিষয় জেনে নিতে হবে । যথা-

১.কী পরিমাণ সম্পদ থাকলে যাকাত আদায় ফরয হয়।

২.কতটুকু যাকাত আদায় করতে হবে।

৩.যাকাত কিভাবে আদায় করবো।

কী পরিমাণ সম্পদ থাকলে যাকাত আদায় ফরয হয়:

নূন্যতম যে পরিমাণ সম্পদ থাকলে যাকাত আদায় ফরয হয়,তাকে পরিভাষায় ‘নিসাব ’ বা ‘নেসাব’ বলে।
সেই প্রাচীন কাল থেকেই সম্পদের মূল হল দুটি বস্তু। এক, স্বর্ণ। দুই , রূপা। সর্বযুগেই এ দুটি মৌলিক সম্পদ হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। তাই ইসলামের যাকাতের নিসাবের মানদন্ড স্বর্ণ ও রূপাকে সাব্যস্ত করা হয়েছে।

স্বর্ণের নিসাব:

কারো মালিকানায় প্রাচীন হিসাব অনুযায়ী বিশ দিনার আর বৃটিশ হিসাব অনুযায়ী ৭.৫ তোলা বা ভরি স্বর্ণ আর আধুনিক পরিমাপ অনুযায়ী ৮৭.৪৮ গ্রাম স্বর্ণ যদি থাকে তাহলে তার উপর যাকাত ফরয হবে।
উৎস: হাদীস, সুনানে দারা কুতনী ১/৬৯
উল্লেখ্য,এ হল শুধু স্বর্ণের নিসাব। কারো কাছে শুধু স্বর্ণ থাকলে তার জন্য এ নিসাব। স্বর্ণের সাথে অন্য কোন যাকাত যোগ্য সম্পদ যেমন রূপা ,নগদ ক্যাশ ইত্যাদি থাকলে কী করণীয় তা সামনে বলা হবে।

রূপার নিসাব:

প্রাচীন পরিমাপ অনুযায়ী কারো মালিকানায় দুইশত দিরহাম রূপা থাকলে তার উপর যাকাত ফরয হবে। ভারতবর্ষের প্রাচীন পরিমাপ অনুযায়ী উক্ত দুইশত দিরহাম হল, ৫২.৫ তোলা বা ভরি রূপা। আর আধুনিক হিসাব অনুযায়ী ৬১২.৩৬ গ্রাম রূপা। নূন্যতম এ পরিমাণ রূপার মালিক হলে তাকে যাকাত দিতে হবে। এ হল শুধু রূপার নিসাব। শুধু রূপা থাকলে এ নেসাব বা পরিমাণ ধরতব্য হবে।
উৎস: হাদীস, সুনানে দারা কুতনি ১/৬৮

নগদ ক্যাশ ও ব্যবসা পণ্যের নেসাব:

এতক্ষণ আমরা স্বর্ণ রূপার নেসাব জানলাম। কিন্তু আমরা জানি, সম্পদ বলতে শুধু স্বর্ণ রূপা নয়। এছাড়াও নগদ টাকা-পয়সা, ব্যবসায়িক পণ্যও সম্পদ। বর্তমান সময়ে এ সম্পদই বেশী। প্রশ্ন হল , এসব সম্পদের নিসাব কী? বা এসব সম্পদ কী পরিমাণ থাকলে যাকাত ফরয হবে?
এক্ষেত্রে ইসলামের বিধান হল, স্বর্ণ ও রোপ্য ব্যতীত যাকাতযোগ্য অন্যান্য সম্পদ তথা টাকা-পয়সা,ব্যবসায় পণ্য এসবে সোনা বা রূপার উক্ত নিসাব বা পরিমাণের মূল্য ধরতব্য হবে। মাসআলা হল, স্বর্ণ বা রূপা যেটার নিসাব ধরলে যাকাত ফরয হয় সেটা ধরতে হবে। বর্তমানে যেহেতু রূপার মূল্য স্বর্ণের চেয়ে কম তাই টাকা- পয়সা ও ব্যবসায়িক পণ্যে রূপার নেসবাই চূড়ান্ত বিবেচিত হবে।
আর স্বর্ণের নিসাব বিবেচিত হবে কেবল তার জন্য যার কাছে যাকাত যোগ্য সম্পদ বলতে কেবল স্বর্ণ আছে। অন্য কিছু নেই।
এক্ষণে আমরা রূপার নিসাবের বর্তমান হিসাব নিয়ে বিশদ আলোচনা করবো। কারণ এটিই (অধিকাংশ ক্ষেত্রে) বর্তমানে যাকাতের একমাত্র নিসাব।

রূপার মূল্য:

দীর্ঘ সময় ধরে স্বর্ণ-রূপার বাজার পর্যবেক্ষণ ও জুয়েলার্স ব্যবসায়ীদের সাথে আলাপ-আলোচনার পর যে বিষয়গুলো সামনে আসল তা হল,
ক.রূপার কোন মূল্য ধরতব্য হবে?
বাজারে রূপার দুই ধরনের মুল্য প্রচলিত।

১. জুয়েলার্স ব্যবসায়ী কর্তৃক ক্রয় মূল্য:
এখানে উদ্দেশ্য হল,বার বা বিস্কিট আকারে রূপার যে প্লেট থাকে সেটার মূল্য। এটি জুয়েলার্স ব্যবসায়ীরা ব্যবসার জন্য ক্রয় করে থাকে। সাধারণ ক্রেতারা তা কিনে না। ব্যবসায়ীরা তা পাইকারী ও খুচরা দুভাবেই ক্রয় করে। খুচরা রেইট, ৪৯০-৬০০ আর পাইকারী রেইটও এর কাছাকাছি,। ১০-১৫ টাকা বেশী হবে।

২. সাধারণ ক্রেতা কর্তৃক ক্রয় মূল্য:
এটি দুই ভাবে হয়। এক. আসল মূল্য। দুই হল, লোকাল রেইট।
এক.আসল মূল্য : এটি প্রথমোক্ত মূল্যের চেয়ে কিছুটা বেশী হয়। যেমন প্রথমোক্ত মূল্য ৬০০ হলে সাধারণ ক্রেতাদের জন্য তা হয় ৬৫০ বা এর কিছু কম বেশি। এটিই রূপার আসল ক্রয় মূল্য। তবে এ মূল্যটা সব জায়গায় পাওয়া যায় না। আমাদের ঢাকা শহরে তাতী বাজারে তা পাওয়া যায়।
দুই:লোকাল রেইট: এ রেইটটা আপনার আশে পাশের মার্কেটে পাবেন। এ রেইটটা হল, ৮০০,১০০০ ,১০৫০ এমন হয়ে থাকে। ( ভরি প্রতি)। এ রেইট বেশি হওয়ার কারণ হল, ব্যবসায়ীরা আসল মূল্যের সাথে নিম্নোক্ত মূল্য গুলো এর সাথে এড করেছে। তা হল,
পরিবহন চার্জ। বা ক্যরি চার্জ।
দোকান চার্জ।
সর্বোপরি তার ব্যবসার প্রফিট।

বাংলাদেশ জুয়েরার্স সমিতি (বাজুস) মূলত এ রেইটটা ঘোষণা করে। যেমন এখন রেইট আছে, ১০৪৯ ( ভরি প্রতি) দেখুন,
www. bangladeshtrades.com

এখন প্রশ্ন হল ,যাকাতের ক্ষেত্রে কোন মূল্য ধরতব্য হবে?

যাকাতের নিসাবের ক্ষেত্রে এখানে ২ এর ক,তথা রূপার আসল সর্বসাধারণ কর্তৃক ক্রয় মূল্য ধরতব্য হবে। কারণ একজন সর্ব সাধারণের জন্য রূপার আসল ক্রয় মূল্য এটিই। প্রথমটি ধরতব্য নয় এ জন্য যে, সেটি সাধারণের ক্রয় মূল্য নয়। ওই মূল্য দিয়ে সে ওই পরিমাণ রূপার মালিক হতে পারবে না। আর শেষেরটা ধরা হবে না এ জন্য যে,এটি আসল মূল্য নয়।

উক্ত বিশ্লেষণ অনুযায়ী, রূপার বর্তমান নেসাব হয়, ৬৫০*৫২.৫=৩৪১২৫ টাকা। সুতরাং নূন্যতম চৌত্রিশ হাজার টাকা ক্যশ থাকলে বা এ মূল্যমানে ব্যবসায়িক পণ্য বা কিছু স্বর্ণ ও টাকা মিলে বা স্বর্ণ,রূপা ও টাকা মিলে মোটকথা যে কোন ভাবে এ পরিমাণ টাকা থাকলে বা এর সমমূল্যের যাকাতযোগ্য সম্পদ থাকলে যাকাত ফরয হবে।

বাংলাদেরশের নির্ভরযোগ্য ফিকহ ও ফতোয়ার প্রতিষ্ঠান মারকাযুদ্দাওয়া আল ইসলামিয়ার সিদ্ধান্তও এটিই যে, বর্তমান যাকাতের নিসাব চৌত্রিশ হাজার টাকা। ওখানের মুহতারাম উস্তায মুফতী ইয়াহইয়া ছাহেব দা.বা. জানালেন, পাকিস্থানের ওলামায়ে কেরামও এর কাছাকাছি নেসাব ঘোষণা করেছেন।

খ. রূপার কোন ক্যরেট ধরতব্য হবে?

বাজার যাচাই করে জানা গেল, সাধারণত রূপার ক্যারেট ২০-২১হয়। স্বর্ণের মত এখানে ক্যরেটের বিষয়টা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাদের দেশে সাধারণত ২১ ক্যারেটের রূপার হিসাব দেয়া হয়ে থাকে। দেখুন,…….
আমেরিকা বা ইউ.এস. এ. এর স্টেন্ডারড হল, ১৪ ক্যরেট রূপা। সৌদী আরবের স্টেন্ডারড হল, ২১ ক্যরেট। পর্তুগালের স্টেন্ডারড হল, ১৯.২ ক্যরেট রূপা। দেখুন, www.bangladeshtrades.com

গ. পাইকারী না খুচড়া মূল্য ধরতব্য?
দুটিই ধরা যায়। যেটা ধরলে গরীবের উপকার হবে সেটা বিবেচিত করাই কাম্য।
কতটুকু যাকাত আদায় করতে হবে:

উপরোক্ত পরিমাণ সম্পদ থাকলে (৩৪হাজার টাকা) নি¤েœাক্ত শর্তে আড়াই পারসেন্ট যাকাত আদায় করবে।
শর্ত হল,
ক, ঋণ মূক্ত হওয়া। (বিশেষ কিছুঋণ)
খ. এক বছর অতিক্রান্ত হওয়া। ইত্যাদি। (মূল নিসাবের উপর,ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সকল টাকা বা পণ্যের উপর নয়)

যাকাত কিভাবে আদায় করবো:

যাকাতের নির্দিষ্ট খাতে যাকাতের নিয়তে যাকা আদায় করে দিতে হবে।

প্রকাশ থাকে যে, প্রথম বিষয়টিই এখানে বিশদ ভাবে বলা উদ্দেশ্য। বাকী দুটি বিষয় প্রসঙ্গক্রমে সংক্ষিপ্তাকারে বলা হয়েছে। বিশদভাবে জানার জন্য বিজ্ঞ কোন মুফতী সাহেবের শরণাপন্ন হওয়া জরুরী।

আরো পড়ুন পোস্ট করেছেন

Comments

লোড হচ্ছে...
শেয়ার হয়েছে