লেখকঃ আব্দুল্লাহ আল মাছুম।
(গত পর্বে বলেছিলাম,এ পর্বে ‘ হারাম থেকে বেঁচে থাকার মৌলিক নীতিমালা: বাস্তব উদাহারণ ও প্রয়োগক্ষেত্রসহ’ আলোচনা করব। কিন্তু এর আগে আরো কিছু বিষয় আলোচনা করা প্রয়োজন। তা হল,হালাল-হারামের পরিধি ও হালাল-হারামের স্তর। এ দুটি বিষয়ে এ পর্বে আলোচনা করব। ইনশাআল্লাহ। )
——————————————————-
হালাল-হারামের পরিধি:
—————————————————————-
ইসলামে হালাল-হারামের পরিধি ব্যাপক। এ শুধু মুআমালা বা লেনদেনের সাথেই সম্পৃক্ত নয়। বরং জীবনের প্রতিটি ধাপের সাথে সম্পৃক্ত। ব্যক্তি জীবন থেকে নিয়ে ,সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অংগনের সবক্ষেত্রেই হালাল-হারামের বিষয় আছে। যেমন-
ঈমান ও আকাঈদ:
আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা হরাম।
পানাহার:
কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-“তোমাদের প্রতি হারাম করা হয়েছে মৃত জন্তু,রক্ত,শূকরের গোশত,সেই পশু,যাতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নাম উচ্চারিত হয়েছে,শ্বাসরোধে মৃত জন্তু,প্রহারে মৃত জন্তু,উপর হতে পতনে মৃত জন্তু,অন্য কোনও পশুর শিংয়ের আঘাতে মৃত জন্তু এবং হিং¯্র পশুতে খেয়েছে এমন জন্তু,তবে (মরার আগে তোমরা) যা যবেহ করেছ,তা ছাড়া…(সূরা মায়িদা: ৩)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-“ হে মুমিনগণ! মদ,জুয়া,প্রতিমার বেদী ও জুয়ার তীর এসবই অপবিত্র,শয়তানের কাজ। সুতরাং এসব তোমরা বর্জন কর,যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।”-সূরা মায়িদা:৯০-৯১
বিবাহ-শাদী:
কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-“তোমাদের উপর হারাম করা হয়েছে তোমাদের মাতা…(সূরা নিসা: ৪৫)
এভাবে জীবনে সর্বস্তরে হালাল ও হারাম ছড়িয়ে আছে। আমাদের প্রতি নির্দেশ, হালাল পথে চলা। আর হারাম বর্জন করা।
হালাল-হারামের চার স্তর
—————————————————————
হারাম মৌলগতভাবে সর্বাবস্থায় নিকৃষ্ট ও বর্জনীয়। তদ্রƒপ হালালও মৌলগতভাবে বৈধ ও গ্রহণীয়। তবে গরম ও ঠান্ডার যেমন স্তর হয়। কোনটা বেশি গরম, কোনটা অল্প গরম। ঠান্ডার মধ্যে কোনটা বেশি ঠান্ডা। কোনটা হালকা। তেমনি হালাল-হারামেরও বিভিন্ন স্তর হয়। কোনটার হারাম অধিক প্রবল। কোনটার হালকা। হালাল-হারাম অনুযায়ী চলার জন্য এসব স্তর জানা একান্ত জরুরী। এক্ষণে আমরা হালাল-হারামের গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্তর নিয়ে আলোচনা করব । আল্লাহই তাওফীকদাতা।
সাধারণত হালাল-হারামের চারটি স্তর রয়েছে। যথা-
———————————————–
স্তর ০১:
————————————————–
সুস্পষ্ট হারাম। যাতে লিপ্ত হলে ব্যক্তি ফাসেক হয়ে যায়। যা জাহান্নামে আবাসের কারণ হয়। এগুলো মূলত সেসব হারাম যা উলামায়ে কেরাম সর্বসম্মতিক্রমে হারাম হওয়ার ব্যাপারে ফতোয়া দিয়ে থাকেন। আমরা যখন কোন কিছুকে হারাম বলি,তখন সাধারণত এ স্তরকেই নির্দেশ করা হয়। যেমন সুদ হারাম। ঘুষ হারাম। চুরি হারাম। ইত্যাদি। এ স্তরের হারাম হল হারামের সর্বোচ্চ স্তর। এটি কবিরা গুনাহ। এটি সর্বস্তরের মুসলমানদের স্তর। সকল মুসলমানদের জন্য এ স্তরের হারাম থেকে বেঁচে থাকা ফরয।
স্তর ০২ :
———————————-
সালেহীনদের স্তর। এটি হল,এমন বিষয় যার মধ্যে হারামের কিছু না কিছু সম্ভাবনা বা উপাদান আছে। তবে হালালের প্রাধান্য বেশি। যারা সালেহীন তারা এ স্তরের হারাম থেকেও বেঁচে থাকেন। তবে সাধারণ মানুষের জন্য মুফতীগণ এ স্তর হারামের ফতোয়া দেন না।
এ স্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, সন্দেহপূর্ণ বিষয় থেকে বেঁচে থাকা।
সন্দেহের তিন স্তর। যথা-
—————————————————————
ক. এমন সন্দেহ যা থেকে বেঁচে থাকা ওয়াজিব। এটি হুকুমের দিক থেকে প্রথম স্তরের অন্তর্ভুক্ত। যেমন এমন লোকের হাদিয়া গ্রহণ করা,যার অধিকাংশ উপার্জন হারাম। (আরো বিশদ উদাহরণ সামনে আসছে।)
খ. এমন অহেতুক সন্দেহ যা থেকে বেঁচে থাকার কোন নির্দেশ নেই। বরং তা পরিহার করা মাকরুহ। মূলত যারা ওয়াসওয়াসার রোগে আক্রান্ত তারাই এ স্তরের শিকার হয়।
যেমন মুসলিম এলাকার হোটেল থেকে মুরগীর গোশত না খাওয়া। এ সন্দেহে যে, মুরগী যবাইয়ের সময় বিসমিল্লাহ মনে হয় বলা হয়নি।
দোকান থেকে পান না খাওয়া,এই মনে করে যে, পান যে পানি দ্বারা ধুয়েছে তা মনে হয় পাক নয়। এমন অহেতুক সন্দেহ।
এধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত লোক আমাদের সমাজে মোটেও কম নয়। আমি আমার ফতোয়া বিভাগের ক্ষুদ্র জীবনে এমন বহু লোকের দেখা মিলেছে।
এক লোক সবসময় সন্দেহ করত,তার কোন কথায়,কখন জানি স্ত্রী তালাক হয়ে গেছে।
আরেক পরিচিত ভাই,আত্মীয়-স্বজন,বন্ধু কারো বাসায় কিছুই খান না,শুধু এই সন্দেহ করে যে, হয়ত,তাকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে আপ্যায়ন করা হচ্ছে না।
আরেক ভাই, শরীরে বা কাপড়ে সামান্য নাপাক লেগে গেলে তা ধুইতে ধুইতে নিজেই পরে অসুস্থ হয়ে যান।
এ রোগ বহু শারীরিক রোগ থেকেও ভয়ংকর। অত্যন্ত পীড়াদায়ক। দেখলে মনে হবে, সুঠাম দেহের অধিকারী সুস্থ মানুষ। কিন্তু ভিতরে ভিতরে মানসিকভাবে মরণাপন্ন রোগী।
ইসলামকে ইতিবাচকভাবে পূজিঁ করে শয়তান এ রোগ যার মধ্যে একবার বিস্তার করে ,সে এক সময় ধর্মের প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়ে। যার শেষ পরিণতি-নাস্তিকতা।
এ ধরনের এক রোগী আমাকে এসে বলেছিল,সব সময় মনে হয়,আমি হারামে আছি,আমার সাথে নাপাক লেগে আছে। এর চেয়ে ভাল হয়,আমি নাস্তিক হয়ে যাই। তাহলে আর এসব চিন্তা আসবে না। আলহামদুলিল্লাহ,দীর্ঘ দিন আমার ট্রিটমেন্টের পর এখন সে অনেকটাই সুস্থ। এ ধরনের কিছু মানসিক রোগীদেকে ট্রিটমেন্ট করার অল্প কিছু অভিজ্ঞতা অধমের আছে। আলহামদুলিল্লাহ।
গ. এমন সন্দেহ যার থেকে বেঁচে থাকা প্রথমটির ন্যায় ওয়াজিব নয়। তবে মুস্তাহাব। এ স্তরের ব্যাপারেই হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, دع ما يريبك إلى ما يريبك
“সন্দেহপূর্ণ বিষয় ত্যাগ করে সন্দেহমুক্ত বিষয় গ্রহণ কর”(জামে তিরমিযী,হাদীস 3378.)
আল্লামা যাবেদী রহ. বলেন,এখানে সন্দেহ ব্যাপক। এটি মুয়ামালা ও ইবাদতসহ সকল শরঈ আহকামেই আসতে পারে। (ইতহাফু সাদাতিল মুত্তাকীন,ক.৬,পৃ. ২৩)
উক্ত হাদীসে বিরত থাকার নির্দেশ,ওয়াজিব নয়;বরং মুস্তাহাব। কেউ এতে লিপ্ত হলে মাকরুহে তানযিহী হবে। যেমন,কেউ কোন প্রাণী শিকার করল। অনেক্ষণ পর তা মৃত পেল। এখন সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে,প্রাণীটি শিকারে মারা গেল,না মাঝখানে অন্য কোন কারণে মারা গেল। এমন সন্দেহ থেকে বেঁচে থাকা জরুরী নয়। তবে মুস্তাহাব। লিপ্ত হওয়া হারামও নয়। তবে সালেহীনদের তাকওয়া হল, এ থেকেও বেঁচে থাকা। ২য় স্তর দ্বারা মূলত সন্দেহের উক্ত ৩য়টি স্তরটিই উদ্দেশ্য। উল্লেখ্য, এমন আরো উদাহরণ সামনে বিশদভাবে উল্লেখ করা হবে ইনশাআল্লাহ।
স্তর ০৩ :
——————————————–
৩য় স্তর হল মুত্তাকীনদের স্তর। এটি হল,এমন বিষয় যা মৌলিকভাবে হালাল। তবে তাতে অধিক জড়ালে নাজায়েয বিষয়ে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এমন বিষয়ে জড়ানো গুনাহ নয়। তবে তাকওয়ার দাবী হল,বিরত থাকা। যারা তাকওয়ার সর্বোচ্চ স্তরে উপনীত হতে চায় তারা এর থেকেও বিরত থাকেন।
এর উদাহরণ হল,
১. ধনাট্য লোকদের গাড়ী,বাড়ীর দিকে দৃষ্টি দেওয়া । তাদের লাইফ স্টাইল দেখা। এটা দেখা মৌলিকভাবে মুবাহ। তবে তাতে লিপ্ত হলে লোভ জাগ্রত হবে। এরপর অল্প সময়ে ধনীলোকদের মত হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু হবে। এর অনিবার্য পরিণতি হল,হারাম আয়ে জড়িয়ে পড়া।
২. বাসে ইচ্ছা করে মহিলার পাশে বসা। এটা মৌলিকভাবে বৈধ । তবে নাজায়েয কল্পনায় জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে।
৩. দোকান থেকে বাকী খাওয়া বৈধ। তবে অভ্যাস হয়ে গেলে ,প্রয়োজন ছাড়াও বাকী খাবে। এরপর সব শোধ হবে না।
এভাবে আমরা চিন্তা করলে এমন বহু বিষয় পাব,যা মৌলিকভাবে বৈধ বা হালাল। তবে এতে অধিক জড়ালে,প্রয়োজনের চেয়ে বেশি গ্রহণ করলে নাজায়েয ও হারামে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
ইমাম গাযালী রহ. লিখেছেন-حكذا المباحات كلها اذا لم تؤخذ بقدر الحاجة في وقت الحاجة مع التحرز من غوائلها بالمعرفة أولا ثم بالحذر ثانيا فقلما تخلو عاقبتها عن خطر
“এরকম প্রত্যেক কাজ যা মৌলিকভাবে মুবাহ। এমন মুবাহ বিষয় যখন প্রয়োজনের সময় প্রয়োজন পরিমাণ গ্রহণ না করে অধিক গ্রহণ করা হয় । তার পরিণতির ভয়াবহতা না জেনে কিংবা বেÑখবর থেকে। এরপর যখন জানে তখন নিজেকে নিবৃত্ত না করে তখন এর পরিণতি খুব কম সময়ই গুনাহ মুক্ত হয়।”(ইতহাফু সাদাতিল মুত্তাকীন,খ.৬,পৃ.২৮)
ইমাম গাযালী রহ.অত্যন্ত মূল্যবান নীতির কথা বলেছেন। বহু বিষয় এমন আছে,যা মৌলিকভাবে মুবাহ । কিন্তু যখন তা লাগামহীভাবে গ্রহণ করা হয়। এর পরিণতি না জেনে । তখন সেটা গুনাহে লিপ্ত হওয়ার কারণ হয়। এমন বিষয় থেকেও শুরু থেকেই বেঁচে থাকা চাই। আর এর পদ্ধতি হল,প্রয়োজনের চেয়ে বেশি গ্রহণ না করা। গ্রহন করলেও পরিণতি সম্বন্ধে পূর্ণ সচেতন থেকে গ্রহণ করা । যেন এ মুবাহ ও হালাল আমাকে হারামে না নিয়ে যায়।
৪র্থ স্তর:
———————————————————–
সিদ্দীকীনদের স্তর। এটি হল,প্রত্যেক মুবাহ ও হালাল জিনিষ নিয়ত পরিশুদ্ধির সাথে গ্রহণ করা। নিয়ত সহীহ করে গ্রহণ করা। যেমন ভাত খাব। নিয়ত করব,আল্লাহর ইবাদতে শক্তি সঞ্চয়ের জন্য আহার গ্রহণ করছি।
শাইখুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহ তাঁর শাইখ ডা.আব্দুল হাই আরেফী রহ.এর সম্বন্ধে লিখেছেন-‘তিনি প্রতিটি মুবাহ ও হালাল বিষয় নিয়ত পরিশুদ্ধির সাথে গ্রহণ করতেন। এমনকি ঘরে প্রবেশ করে ছোট বাচ্চাদেরকে আদর করার পূর্বে মনে মনে নিয়ত করে
নিতেন,নবীজী বাচ্চাদেরকে মহব্বত করতেন,তাই তিনিও করছেন।
ইবাদত ছাড়াও যিন্দেগীর দৈনন্দিন সকল কাজে ইত্তেবায়ে সুন্নাহর নিয়ত তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। তিনি বলতেন, আমি বছরের পর বছর অনুশিলন করেছি,আমার প্রাত্যহিক প্রতিটি কাজ যেন ইত্তেবায়ে সুন্নাহর নিয়তে হয়।
অনুশিলন এভাবে করেছি,সুস্বাদু খানা সামনে আসল। পেটে ক্ষিদাও আছে। প্রবল চাহিদা বিদ্যমান। ঠিক সেই মুহুর্তে খাবার গ্রহণের পূর্বে কিছুক্ষণের জন্য নফসকে থামিয়ে,নিয়ত করেছি, স্রেফ খাহেশাত পূরণের জন্য খাব না। বরং খাব এ নিয়তে যে,এটি আল্লাহর নিয়ামত। প্রিয় নবী কৃতজ্ঞতার সাথে আল্লাহর নেয়ামত গ্রহণ করতেন। এখন সেই সুন্নাহর অনুসরণে খাবার খাব।
ঠান্ডা পানি পানের আগে নিয়ত করে নেই,ঠান্ডা পানি পান করছি,কারণ প্রিয় নবী ঠান্ডা পানি পসন্দ করতেন। তো তাঁর সুন্নতের অনুসরণের নিয়তে পান করব। এভাবে অনুশিলন করেছি। এতে প্রতি মুবাহ ও হালাল কাজের শুরুতে ইত্তেবায়ে সুন্নাহর নিয়ত করার আদত হয়ে গেছে।(মাআছিরে হযরত আরেফী ,পৃ.২৭)
আল্লাহ পাক আমাদেরকে সিদ্দিকীনদের স্তরে উপনীত হওয়ার তৌফিক দান করুন। নবী-রাসূলদের পরই সিদ্দীকীনদের স্তর। প্রতি নামাযে আমরা দুয়া করি,“আমাদেরকে সরল পথে পরিচালিত কর,সেই সকল লোকদের পথে,যাদের প্রতি তুমি অনুগ্রহ করেছ।” সূরা ফাতিহা:৫-৬
উক্ত অনুগ্রহপ্রাপ্ত লোকদের মধ্যে প্রথম সারির হলেন-নবীগণ। এরপরই হলেন-সিদ্দীকিন। দেখুন-সূরা নিসা : ৬৯
———– —————————————————-
(আগামী পর্বে পড়ুন: হারাম থেকে বেঁচে থাকার গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি। উদাহরণসহ।)
সহযোগিতায়ঃ ইসলামী অর্থনীতি ফোরাম, বাংলাদেশ।
Comments