মুমিনের জীবনে দুনিয়া ও আখেরাত

বিছমিল্লাহির রহমানির রহীম।
يا أيها الناس إن وعد الله حق فلا تغرنكم الحياة الدنيا ولا يغرنكم بالله الغرور
হে মানবজাতি! নিশ্চয় আল্লাহর ওয়াদা(পূণর্জীবন) সত্য।সুতরাং দুনিয়ার ধন- দৌলত,টাকা -পয়সা,ঘর-বাড়ী যেন তোমাদেরকে ধোকায় না ফেলে।আখেরাতের আমল থেকে দূরে না রাখে।এবং বিতাড়িত শয়তান যেন তোমাদেরকে আল্লাহর ব্যাপারে প্রতারিত না করে।অর্থাৎ ক্ষমা পাওয়ার প্রলোভনতা দেখিয়ে বারবার গুনাহে লিপ্ত না করে।

এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, একজন মুমিনের অন্তরে দুনিয়ার মুহাব্বত,ভালবাসা প্রবেশ করতে পারেনা।রাসুল(স:) বলেন:- حب الدنيا رأس كل خطيئة
“দুনিয়ার ভালবাসা সকল গুনাহের মূল”।
পৃথিবীতে যত অপরাধ,অন্যায়-অনাচার,জুলুম-নির্যাতন হচ্ছে সব কিছুরই মূল দুনিয়ার মুহাব্বত।সুতরাং একজন মুমিনের অন্তরে কখনো পার্থিব জীবনের ধন-সম্পদের ভালবাসা বাসা বাঁধতে পারেনা।জায়গা করে নিতে পারেনা।অন্তরে মুহাব্বত থাকবে একমাত্র আল্লাহর।তবে আরো অনেকের সাথে গভীর্ সম্পর্ক থাকতে পারে।কিন্তু প্রকৃত ভালবাসা একমাত্র তাঁরই সাথে।এ জন্য রাসুল (স:) বলেছেন:-
لو كنت متخذا خليلا لاتخذت ابا بكر خليلا
যদি আমি কাউকে অন্তরন্ঙ বন্ধু বানাতাম, আবু বকরকেই বানাতাম”।কিন্তু আমার আসল বন্ধু আল্লাহ।অন্তরে একমাত্র তাঁরই মুহাব্বত।আল্লামা রুমী(রহ:) বলেন:-
هم خدا خواهي هم دنيای دون
ايی خيال است ومحال است وجنون
“অন্তরে দুনিয়ার মুহাব্বতও থাকবে,আল্লাহর মুহাব্বতও থাকবে, এমন হতে পারেনা।এটা শুধু খামখেয়ালী,অসম্ভব ও পাগলামী”।

দুই: কুরানের বিভিন্ন আয়াত ও হাদিসে দুনিয়ার বর্ৎসনা করা হয়েছে।দুনিয়াকে ফিতনা বলা হয়েছে।যেমন,
وما الحياة الدنيا إلا متاع الغرور
“দুনিয়ার জীবন হলো শুধু ধোকার উপকরণ”
অন্য আয়াতে এসেছে:-
إنما أموالكم وأولادكم فتنة
“তোমাদের ধন-সম্পদ,সন্তান-সন্ততি হলো পরীক্ষাসরুপ”।
আমাদের মাঝে প্রসিদ্ধ একটি হাদিসে(দূর্বল) বলা হয়েছে,
الدنيا جيفة وطالبوها كلاب
দুনিয়া হল মৃত পশুর মত।আর তা তলবকারী কুকুরের মত।
এ ধরণের আরো অনেক আয়াত ও হাদিস পাওয়া যায়, যেগুলো বাহ্যিক দৃষ্টিতে দুনিয়া বিমূখ হওয়ার কথা বলে।

তিন: আবার কুরান ও সুন্নাহতে এমন অসংখ্য আয়াত ও হাদিস পাওয়া যায়, যেগুলো দুনিয়া হাছিলের কথা বলে।যেমন কুরানে আল্লাহ বলেন:-
فإذا قضيت الصلاة فانتشروا في الأرض وابتغوا من فضل الله
“অতঃপর যখন জুমার নামাজ শেষ হবে তেমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়।এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর”।
অন্য আয়াতে বলন:-
وابتغ فيما أتاك الله الدار الآخرة ولاتنس نصيبك من الدنيا
“রাব্বুল আলামীন তোমাকে যে সম্পদ দান করেছেন তার মাধ্যমে আখেরাতকে তালাশ কর।এবং দুনিয়াতে তোমার নিজের অংশ ভূলে যেওনা”।
অন্য হাদিসে দুনিয়া বিমূখতাকে চিরতরে না করা হয়েছে।রাসুল(স:)বলেন:-
لا رهبانية في الإسلام
“ইসলামে বৈরাগ্যতার কোন স্হান নেই”।ঘর-বাড়ি, সন্তান-সন্ততি,ব্যাবসা-বাণিজ্য (যার অপর নাম দুনিয়া) ছেড়ে ইবাদত-বন্দেগী ইসলাম সমর্থন করেনা।

চার: দুনিয়া হাছিলের পক্ষে-বিপক্ষে কুরান ও সুন্নাহয় বর্ণিত বিভিন্ন আয়াত ও হাদিসের আলোকে আমাদের অনেকের মাঝে এই প্রশ্ন বারবার ঘূরপাক খাই যে, দুনিয়া ও আখেরাতের মাঝে সমন্বয় কিভাবে সম্ভব? দুনিয়া তলব করতে গেলে আখেরাত বিনষ্ট হয়।আখেরাত তলব করতে গেলে দুনিয়া বিনষ্ট হয়।দুনিয়া ও আখেরাত কি একটি অপরটির বিপরীতমূখী? তাহলে কি দুনিয়া তলব করা যাবেনা? প্রশ্ন জাগে, দুনিয়া কেনই বা তলব করব? রিযিক ত আল্লাহর দরবারে নির্দিষ্ট।আমি চাইলেই অর্জন করতে পারবনা।
সুতরাং একজন মুমিনের সাথে দুনিয়ার কেমন সম্পর্ক হওয়া উচিত?
এ সব প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, কুরান ও হাদিসের কোথাও প্রকৃতপক্ষে দুনিয়া বিমূখ হতে বলা হয়নি।দুনিয়া ও আখেরাত একটি অপরটির বিপরীতমূখীও নয়।বরং আমাদের ভূল বুঝাবঝি।যে সব স্হানে দুনিয়ার বর্ৎসনা করা হয়েছে সেখানে মূলত দুনিয়া ও তার তলবকারীকে তখনই নিন্দা করা হয়েছে যখন মুমিনের অন্তরে একমাত্র আল্লাহর মুহাব্বত থাকার পরিবর্তে দুনিয়ার মুহাব্বত, ভালবাসা, সম্পদের লালসা ঢুকে পড়েছে।অন্তরে মুহাব্বত থাকবে একমাত্র আল্লাহর।ধন-দৌলত, টাকা -পয়সা, ব্যাবসা -বাণিজ্য ইত্যাদির সাথে মুমিনের সম্পর্ক থাকবে।থাকতে হবে।তবে এ সম্পর্ক হবে বেঁচে থাকার জন্য।প্রয়োজন মেঠানোর জন্য।
মুমিন আর দুনিয়ার মাঝে এ সম্পর্ককে আল্লামা রুমী(রহ) নৌকা ও পানির মধ্যকার সম্পর্কের সাথে তুলনা করেছেন।তিনি বলেন:- মানুষের উদাহরণ হল নৌকা।আর দুনিয়ার উদাহরণ হল পানি।পানি ছাড়া যেমন নৌকা চলতে পারেনা তেমনিভাবে দুনিয়া ছাড়া মুমিনের জীবন চলতে পারেনা।এ দুনিয়াতে মানুষের অসংখ্য প্রয়োজন আছে।যেমন, বেঁচে থাকার জন্য ধন-দৌলত, টাকা-পয়সা, ঘর-বাড়ী, খাবার-দাবার, কাপড়-চুপড়, বাসস্হান ইত্যাদি।মূলত এ গুলো দুনিয়া।কিন্তু যেভাবে পানি নৌকার জন্য ততক্ষণ পর্যন্ত উপকারী যতক্ষণ পানি নৌকার নিচে, ডানে-বামে ও আগে-পিছে থাকে।যদি পানি ডান-বামের পরিবর্তে নৌকার ভিতরে প্রবেশ করে নৌকা ডুবে যায়।
তেমনিভাবে দুনিয়ার আসবাব পত্র, ধন- দৌলত যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের প্রয়োজন মেঠাতে তার চারপাশে থাকে।অন্তরে থাকে একমাত্র আল্লাহর মুহাব্বত, কোন ভয় নেই।কারণ এ সম্পদ মানুষের জীবনের নৌকাটি পরিচালনা করে।যেভাবে পানি নৌকাকে পিরচালনা করে।কিন্তু যদি দুনিয়ার এই চাকচিক্য,অট্টালিকা মানুষের চারপাশ থেকে সরে অন্তরের নৌকায় আল্লাহর মুহাব্বতের জায়গাটি দখল করে নেয় নিশ্চিত তাকে ডুবিয়ে মারবে।ধ্বংস করবে।একজন দুনিয়া তলবকারী হিসাবে ঘৃণিত ব্যক্তিতে পরিণত হবে।
তাই আল্লামা রুমী(রহ) বলেন:-
آب أندر زير كشتي فشتي است
آب در كشتي هلاك كشتي است
পানি যখন নৌকার চারপাশে থাকে নৌকাকে পরিচালনা করে, ধাক্কা দেয়।কিন্তু পানি যদি নৌকার ভিতরে প্রবেশ করে নৌকাকে ডুবিয়ে ফেলে।
সুতরাং মুমিনের জীবনে দুনিয়ার সম্পর্ক হল হালাল রিযিক তালাশের মাধ্যমে বেঁচে থাকা ও প্রয়োজন মেঠানোর সম্পর্ক।আর আখেরাতের সম্পর্ক হল নেক আমলের মাধ্যমে অন্তরে আল্লাহর মুহাব্বত সৃষ্টি করা।

লেখক:
নুরুল আলম
মাষ্টর্স (ইসলামী অর্থনীতি)
মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
মদিনা মুনাওয়ারা,সৌদিআরব।

আরো পড়ুন পোস্ট করেছেন

Comments

লোড হচ্ছে...
শেয়ার হয়েছে