ঈদ

ফাহমিদা রায়হান

শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ শাহজাহান। মুঘল সম্রাট যদি আমাদের সাবুদ্দিন-এর (শাহাবুদ্দিন) এমন বেহাল অবস্থা দেখতেন, তবে তার নামে নাম রাখার অপরাধে, শুলে চরানোর আদেশ দিতেন। পিতামাতার দেয়া নামের মর্যাদা সাবুদ্দিন রাখতে পারেনি। তার পরনের বহু ব্যবহৃত লুঙি, ভাঙা ঘর আর বাচ্চাদের নোংরা কাপড়চোপড় দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়। কিন্তু সাবুদ্দিন হাল ছাড়ার পাত্র না, দারিদ্রকে জয় করার অদম্য চেষ্টার ছাপ তার চোখে মুখে। সেই সকালে যায় কাজে, মাছিমপুর এর মোড়ের পয়েন্টে বসে অন্য সবার সাথে, যদি কোন কাজ পায়। যেদিন জোটে সেদিন খায়, আর যেদিন জোটেনা সেদিন আর দশ জন গরিবের মতই কষ্টে কাটায়। তার ছোট ছেলেটার নাম কাশেম। দেবতা যদি থাকতো হয়ত কাশেমকে দেখে হিংসেই করত! সাবুদ্দিনও মাঝে মাঝে চিন্তায় পড়ে যায়, এত সুন্দর দেবদূতের মত ছেলে তার ঘরে কেমনে আসলো! খুব আদর করে ছেলেকে। কিন্তু বুঝতে দেয় না। বুঝলে মাথায় উঠবে, পরে মুতে দিবে।

এদিকে, রাহাত কদিন হয় ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসেছে। ভার্সিটি বন্ধ হয়ে গেলেও টিউশনিটার জন্য আসতে পারেনি। হাত খরচটা নিজেই চালানোর চেষ্টা করে সে। গত মাসের টাকাটা রেখে দিয়েছিল। বাড়ি আসার সময় ছোট ভাইবোন দুটোর জন্য নতুন জামা নিয়ে এসেছে।

আজ ঈদের চাঁদ দেখা গেল! কাল খুশির ঈদ। রাহাতের বাসায় কেমন ঈদের আমেজ।মা পিঠা বানাতে ব্যস্ত। এশার নামাজ শেষে গ্রামের বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিড়তে বেশ রাত হয়ে গেল রাহাতের। বাড়ির সামনে আসতেই চোখ পড়ল আম গাছটার নিচে, কে যেন মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। তাদের গ্রামের সাবুদ্দীন চাচা! ক্ষনে ক্ষনে কেঁপে উঠছে সাবুদ্দিন!

কাছে গিয়ে রাহাত কাধে হাত রেখে বলল, চাচা কি হয়েছে?

সাবুদ্দীন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, হু হু করে কেঁদে উঠল!

কিছু বলতে গিয়েও পারল না যেন, গলা জড়িয়ে আসল। অন্য ছেলেমেয়েরা যখন ঈদের চাঁদ দেখায় ব্যস্ত, নতুন জামা কাপড় নিয়ে ঈদের অপেক্ষায়, আর সাবুদ্দীন কিনা ছোট ছেলেটাকে যাচ্ছেতাই ভাবে মেরে এসেছে। তার কিছু করারও ছিল না। ছেলে বায়না ধরেছে এই ঈদে নতুন জামা চাই। তার যা রোজগার! আর এখন চারপাশে থৈ থৈ পানি। এমন বর্ষায় কাজও পাওয়া যায় কম। কদিন ধরে পেট রাখাই দায়, তার উপরে এই বায়না! মেজাজ খারাপ করেই দুইটা রাম থাপ্পড় লাগিয়েছিল। চুপ মেরে গিয়েছিল ছেলেটা। কান্নাভরা চোখে এখন হয়ত ঘুমিয়েও পড়েছে। এই খারাপই লাগছে সাবুদ্দিনের। মারা উচিত হয় নাই। হাজার হোক অন্যায় কিছু চায়নি ছেলেটা।

সে নিজেও তো কম চেষ্টা করেনি! কাজ না পেয়ে ধারের জন্যও দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে! তার মত দিন মজুরকে ধার দেয়ার মানুষেরও বড্ড অভাব!

দোকানে কত নতুন জামা তার চোখের সামনে ঝুলছিল! কটা টাকা হলেই ছেলের মুখে হাসি ফুটাতে পারত।

কাল হয়ত চোরের ঘরেও ঈদ আসবে, আসবে না শুধু তার ঘরে! সাবুদ্দিনের মুখে ঈদের আনন্দের লেশমাত্র নেই। তাই হয়ত চাঁদও লজ্জা পেয়েছে। কালো মেঘে টুপ করে লুকিয়েছে। রাহাতের নিজেকে বড্ড শূন্য মনে হল, আশপাশেই এমনও দেখতে হবে, ভাবেনি সে। ঈদের মানেটাই ভুলে যেতে ইচ্ছে করল। ঈদ আসে খুশি নিয়ে, কথাটা আজ মেলানো গেল না।

রাহাত সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা পেল না। শেষে সাবুদ্দিনকে দাড় করিয়ে ঘরে গেল। ফিরে আসল ছোট ভাইয়ের জন্য আনা সেই জামাটা নিয়ে। তার ভাইয়ের তো ঈদে পরার আরও আছে। কিন্তু সাবুদ্দিনের ছেলের?

জামাটা পেয়ে সাবুদ্দীনের চোখ লুকোলো। হয়ত কান্নাই লুকোলো।

ঘুমানোর সময় রাহাত একবার ফেইসবুকে উকি দিল, ঈদ নিয়ে কত পোস্ট!

“হাই ফ্রেন্ডস, নতুন মোবাইল আইফোন ৬ কিনলাম সাথে ঈদের লটস অব শপিং! লাইফ এত মজার কেন!”
তিনার দেয়া সেলফি আর ক্যাপশন টা দেখলো রাহাত। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল রাহাতের।

পরদিন সকাল। ঈদের জামাত শেষে সবাই কোলাকুলি করছে। একটু দূরে কাশেম তার কোমল হাতে বাবার আঙ্গুল ধরে দাঁড়িয়ে। পরনে রাহাতের দেয়া জামাটা। কাশেমের হাসিহাসি সুন্দর মুখটা দেখে রাহাতের চোখ যেন তৃপ্তিতে ভরে গেল। ঝাপসাও দেখতে লাগল। এ কিসের অশ্রু জানা নেই।

সে আজ কি পেল তা নিজেই জানে। এইবারের ঈদটা এত খুশি নিয়ে আসবে ভাবেনি সে।