ইসলামে আনন্দ দিবসের তাৎপর্য

কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক

চারপাশে ভালো করে তাকালে দেখতে পাবেন কিছু মানুষ বেশ হাসিখুশি। কষ্ট নামের কোনো বস্তুর সাথে কখনো যেন দেখাই হয়নি এদের। সবকিছুতেই সন্তুষ্টি ভাব। নিজের চারপাশটাকে করে তুলছে আনন্দময়। কি ভাবছেন? নিশ্চয়ই অনেক বেশি প্রাচুর্যে ভরপুর তাদের জীবন? না! ঠিক তা নয়। আসলে খুশী আর আনন্দ মানুষের জন্য একটি স্বাভাবিক দাবী ও প্রাকৃতিক নিয়ম। ইসলাম মানুষের স্বাভাবিক চাহিদা ও গুরুত্ব অনুভব করে এবং কতিপয় সীমারেখা ও শর্তসাপেক্ষে এ প্রয়োজনসমূহ পূরণ করতে উৎসাহ প্রদান করে। দীন কখনো এটা চায় না যে, তুমি কপট গাম্ভীর্য, অবাঞ্চিত মর্যাদা, সর্বদা মনমরা ভাব ও নির্জীবতা দ্বারা তোমার কর্মকুশলতা ও যোগ্যতাকে নিস্তেজ করে দেবে। আল্লাহর মনোনীত দীন ইসলাম তোমাকে খুশী ও আনন্দ প্রকাশের পূর্ণ অধিকার প্রদান করে। এও দাবী করে যে, তুমি সর্বদা উচ্চ আকাঙ্ক্ষা, সতেজ উদ্যম ও নব উদ্দীপনায় সজীব থাকো।

সেই সূত্রে ঈদ সহ বিভিন্ন উৎসবে নির্মল আনন্দে মেতে ওঠার একটা ঐতিহ্য রয়েছে বাঙালি মুসলমানদের। জাতি হিসেবে আমরা বরাবরই আবেগপ্রবণ ও উৎসববিলাসী। উপলক্ষ্য যাই হোক, সৌহার্দ্যপূর্ণ পারিবারিক ব্যবস্থা এবং সামাজিকতার প্রগাঢ় বন্ধনের কারণে আনুষ্ঠানিকতার বিষয়টি আমাদের কাছে অধিক গুরুত্ব পায়। সুস্থ ও গতিশীল সমাজব্যবস্থার জন্য এর প্রয়োজন আছে। তবে অপ্রয়োজনীয় বাড়তি মাতামাতি ও বাহুল্য নিমগ্নতার কারণে যেকোনো উৎসবের প্রকৃত আবেদনটা যাতে ম্লান না হয়ে যায়, সে দিকেও দৃষ্টি রাখা জরুরি। অন্যথায় উৎসবের বাহ্যিক অবয়ব টিকে থাকলেও থাকে না এর কোনো প্রাণ। আমেজ ও প্রতিফলনের কাঙ্ক্ষিত রূপটি খুঁজে পাওয়া যায় না। বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক অনেক উৎসবই আজ নিষ্প্রাণ ও নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে এ কারণে। উৎসব আছে, এর কোনো প্রাণ নেই; মাতামাতি আছে, কিন্তু মূল আবেদন হারিয়ে গেছে।

তারপরও বছরান্তে মুসলমানদের জন্য অফুরন্ত খুশির বার্তা নিয়ে হাজির হয় দুটি দিন- ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। ধনী-গরিব, ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মুসলমানের জীবনে ঈদ হাজির করে আনন্দের বন্যা। এমনকি আমাদের দেশে অন্যান্য ধর্মের মানুষকেও ঈদের আনন্দ স্পর্শ করে। মানবিক সাম্য, ত্যাগ ও সহমর্মিতার বিস্ময়কর ও অপরূপ আলোকপ্রভা ঈদের উৎসবে প্রকাশিত হয়, যা ইসলামের মহত্ত্ব ও সর্বজনীনতার প্রতীক। আরবি ‘আজহা’ শব্দের অর্থ- ত্যাগ স্বীকার, কোরবানি প্রভৃতি। ঈদুল আজহায় আল্লাহর রাহে ত্যাগ ও কোরবানির চেতনা ভাস্বর হয়ে ওঠে। পশু জবেহ করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রচেষ্টা মানব ইতিহাসের জন্মলগ্ন থেকেই চলে আসছে। কোরবানি এমন একটি মর্যাদাকর বিষয়, যাতে রয়েছে একাধারে আত্মগঠন এবং সুস্থ সমাজ গঠনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপাদানসমূহ।

ইসলামী জীবন ধারায় ব্যক্তির জন্য সর্বোচ্চ খুশী নিহিত রয়েছে তার প্রভু আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি বিধানে। যার চর্চা ইসলামের বাইরে আর কোথাও দেখা যায় না। পূজা উৎসবসমূহ, নওরোজ, ক্রিসমাস ডে, ভালোবাসা দিবস, জন্ম দিবস, বিবাহ বার্ষিকী ইত্যকার নানা উৎসবের লক্ষ্য উদ্দেশ্য নানা প্রকার । তার সবগুলোই জাগতিক কোনো দেনা-পাওনার হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। কিন্তু মুসলিম জীবনাচারের সবটুকু যেহেতু এই পৃথিবীই নয়; বরং তাদের জন্য পৃথিবী এক স্বল্পকালীন কর্মক্ষেত্র, তাই এ কর্মক্ষেত্রের একমাত্র উদ্দেশ্য এবং সর্বোচ্চ সাফল্য হলো- তারা তাদের প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জন করবে। আর তা সম্ভব তাদের প্রভু আল্লাহর বিধান মোতাবেক জীবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত করবে। তাঁরই প্রেরিত রাসূলের দেখানো পন্থা-পদ্ধতি অনুযায়ী চলবে। মূলত এতেই লুকিয়ে রয়েছে মুমিনের অন্তরের খুশীর রহস্য ও আনন্দের মহিমা।

বৈধ স্থানসমূহে খুশী প্রকাশ না করা এবং খুশী বা আনন্দ উদযাপনকে দীনী মর্যাদার পরিপন্থী মনে করা দীনের প্রকৃত জ্ঞান নেই এমন লোকের পক্ষেই সম্ভব। তোমার কোনো দীনী কর্তব্য পালনের সৌভাগ্য লাভ হলো, তুমি বা তোমার কোনো বন্ধু যোগ্যতার দ্বারা উচ্চাসন লাভ করলেন, আল্লাহ তাআলা তোমাকে ধন-দৌলত অথবা অন্য কোন নেয়ামত দান করলেন, তুমি কোন দীনী সফর শেষে বাড়ীতে ফিরলে, তোমার বাড়িতে কোনো সম্মানিত মেহমানের আগমন ঘটল, তোমার বাড়ীতে বিয়ে-শাদী অথবা শিশু জন্মগ্রহণ করল এবং কোনো প্রিয়জনের সুস্থ অথবা মঙ্গলের সুসংবাদ এলো অথবা কোনো মুসলিম সেনা বাহিনীর বিজয় সংবাদ শুনলে বা যে কোনো ধরনের উৎসব পালন অবশ্যই তোমার জন্মগত অধিকার। ইসলাম শুধু আনন্দ উদযাপনের অনুমতিই দেয় না বরং দীনী দাবীর অংশ হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়।

ঈদে এক মুসলমান অপরকে অভিবাদন জানানোর প্রথা সাহাবাদের যুগ থেকেই প্রচলিত হয়ে আসছে। [ফাতহুল বারী: ২/৫১৭]। আনন্দ উদযাপনে ইসলামী রুচি, ইসলামী নির্দেশ ও রীতি-নীতির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। যখন আনন্দ উপভোগ করবে তখন প্রকৃত আনন্দদাতা আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করবে। তাঁর দরবারে সেজদায় শোকর আদায় করবে। আনন্দের উত্তেজনায় ইসলাম বিরোধী কোনো কার্য বা রীতিনীতি ও আকিদাবিরোধী কোনো কার্যকলাপ করবে না। আনন্দ প্রকাশ অবশ্যই করবে কিন্তু কখনও সীমালংঘন করবে না। আনন্দ প্রকাশে এতো বাড়াবাড়ির করবে না যাতে গৌরব অহংকার প্রকাশ পায়।

আমাদের এ দীন অনেক উদার, তবে এতো উদারতার পরও যদি কেউ সীমালংঘন করে তবে তার জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তির সংবাদ। ঈদের দিনে মুক্তিপ্রাপ্ত অশ্লীল সিনেমা, নাটক, অনৈসলামিক গান-বাজনা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও এ জাতীয় অনুষ্ঠানাদিতে অংশ নেয়ার মত পাপাচার থেকে আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।