বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ঈদ

নেহাল

কুরবানি ঈদ নিয়ে কথা বলছিলাম , বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কিছু শিক্ষার্থীর সাথে । তারা ঈদ নিয়ে তাদের ভাবনা , অনুভুতি আর স্মৃতি নিয়ে আমাদের সঙ্গ দিয়েছেন ।

ফারিয়া ফারজানা
ফিন্যান্স বিভাগ , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

‘দেখতে দেখতে ঈদ এসেই গেলো। আর কয়েকদিন পর শুরু হবে মানুষের ছুটোছুটি। কেউ ছুটবে বাড়ির পথে, কেউ ছুটবে গরুর হাটে। রমণীকুলেরা ছুটবেন রান্নার সরঞ্জামাদি কিনতে বাজারে। ঈদের আমেজ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে সর্বত্র। রাস্তাঘাটে যানজট এখনি চরমসীমায় পৌঁছেছে। ঈদকে সামনে রেখে শপিংমলগুলো সেজেছে বর্ণিল সাজে। আমাদের একটা প্রথা প্রচলিত ছিল একসময় যে, রোজার ঈদে জামা জুতো, আর কুরবানির ঈদে গরু। কিন্তু এখন কুরবানির ঈদেও নতুন জামা জুতো চাই। সময়ের সাথে সাথে সব বদলে যায়।
আমারও ঈদ কাটে এভাবেই। গরু, কুরবানি নিয়ে ভাবনা। নতুন জামা কাপড় কেনা। মাকে সাহায্য করা হয়। আর রাতে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়া। সব মিলে ভালই কেটে যায়।’

মুহাম্মাদ শারাফাত
দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

‘কুরবানির ঈদ সামনে অাসলেই অতীতের কত রকম স্মৃতি মনে দোলা দেয়। এমনিতেই উৎসব অায়োজনে কুরবানির ঈদ বেশ অানন্দদায়ী। কুরবানির অায়োজনও ব্যাপক অাকারে হয়ে থাকে। অসংখ্য স্মৃতির মধ্যে একটি গল্প প্রায়ই মনে পড়ে। গল্পটি যেমন মজার তেমনি দুঃখজনক। কেন মজার সেই গল্পটাই অাগে বলি। শেষে দুঃখজনক ব্যাপারটি উল্লেখ করব। তিন-চার বছর অাগেকার ঘটনা। কুরবানির ঈদের দিন দুপুরে বের হলাম পাড়া-প্রতিবেশীর কুরবানি দেখতে। দেশে কসাই স্বল্পতার কারণে সেদিন অনেকেই মৌসুমী কসাই সেজে থাকে। সবজি-মাছ ব্যবসায়ী কিংবা রিকশাচালক ধরণের সমাজের নিম্ম শ্রেণীর লোকেরা কসাই হয়ে যায় জীবিকার তাগিদে। যাই হোক, তখন এক কসাইকে দেখলাম খাশির মাথা উপরে, পা নিচের দিকে দিয়ে ছামড়া ছিলছে। দেখেই অবাক হলাম, তারচেয়ে বেশী হাসলাম। কসাইকে জিজ্ঞেস করলাম; মানুষ সাধারণত খাশির চামড়া ছিলে পা উপরের দিকে, মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে। তুমি এমন করলে কেন? সেই কসাইয়ের জবাব অামার ভিতরটা নাড়িয়ে দিয়েছে বেশ। কসাই এর অাগে কখনো খাশি কুরবানি করতে দেখেনি। ব্যাপারটি অদ্ভুত শোনালেও খুবই কষ্টদায়ক। এমন মানুষ সমাজে এখনও অাছে! সমাজের একশ্রেণী ঈদ-অানন্দ করছে, অারেক শ্রেণী জানেই না ঈদ-অানন্দের কথা। কুরবানি বিষয়টিই তো এমন যে, হাসি-অানন্দ সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া। ঈদের স্মৃতি মনে পড়লে এই স্মৃতিটাও হৃদয়ে ভেসে উঠে। অানন্দে কাটুক সবার ঈদ।’

নুসরাত জাবিন বিভা
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

‘সেই ছোটবেলা থেকে এই বেলা পর্যন্ত কুরবানির ঈদ আমার কাছে রুটিনে বাধা। রুটিনে বাঁধা হলেও কখনোই একঘেয়ে নয়। ঈদের আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রস্তুতি। আর কুরবানি ঈদের প্রধান আকর্ষণ গরু কেনা। রাখার জায়গার অভাবের কারণে আব্বু সাধারণত ঈদের অল্প কয়েকদিন আগে গরু কিনতেন। গরু কিনে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। গরু দেখতে আমরা অধীর অপেক্ষায় থাকতাম। শেষমেশ আব্বু গরু নিয়ে ফিরতেন। যথেষ্ট দূর থেকে আমরা গরু দেখতাম। গরু হাম্বা করে ডেকে উঠলেই ভয় পেয়ে যেতাম। এই বুঝি গরু দড়ি ছিঁড়ে এসে ঢুস দিল। তারপর আসতো ঈদের দিন। যাদের বাসায় গরু রাখা হতো তিনি ঈদের দিন সকাল সকাল গরু নিয়ে চলে আসতেন। আব্বু নামায শেষে এসে নিজে হাতে গরু জবাই করতেন। আমি উপরের বারান্দা থেকে দেখতাম। জবাইয়ের সময় যখন গরুর গলা দিয়ে একটা গোঙানির শব্দ বের হতো তখন কেমন একটা কষ্ট লাগতো। এরপর আর যা যা কাজ আছে সেসব করে যখন গোশত বাসায় দিয়ে দিত তখন প্রথমেই আম্মু গোশত কিমা করে কোপ্তা ভাজতেন। এই কোপ্তার স্বাদ বছরের অন্য সময়ের থেকে একদম আলাদা। সারা বছর মনে হয় এই কোপ্তা খাওয়ার জন্যই কোরবানির ঈদের অপেক্ষায় থাকি। এরপর আম্মু গোশত রান্না করে,সবাই মিলে খাই। ফকির-মিসকিনদের অংশ ওদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। আত্মীয়দের বাসায় গোশত পাঠানো হয়,তারা আমাদের পাঠায়। এইভাবেই আমার কোরবানির ঈদ কাটে।’

সুমাইয়া আরেফিন অর্নি
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।

‘ছোটবেলায় বাবার বদলির চাকরির সুবাদে বাইরে বাইরে থাকা হত।ঈদের আগের দিন গ্রামের বাড়ি গিয়ে দেখতে পেতাম চাচারা,চাচাতো দাদুরা কুরবানির ছুরি চাপাতি ঠিক করছেন। সমবয়সী ভাইবোন দের দেখাদেখি পোষা রামছাগল টার গলা ধরে চুপচাপ কাঁদতে লেগে যেতাম। ওদের মত আমি ছাগলটাকে মাঠে ঘাটে ঘুরিয়ে বড় করিনি,তবু কাল থেকে এটা থাকবে না জানলে কষ্ট হত। দাদী বারান্দায় মা চাচিদের ঈদের রান্নার আয়োজন করতেন। আমরা লেগে যেতাম কে কোন জামা কিনেছে তা দেখতে তাদের ঈদ নষ্ট করতে। আমাদের গ্রামে সব কুরবানি একই জায়গায় হয়, কুরবানির সময় আমার বয়সী বাচ্চাকাচ্চাও সেখানে থাকত। প্রতিবার প্রথম কুরবানি টা হলেই কষ্ট লাগতে শুরু করত।আহা! কত আদরের পশুগুলো। ত্যাগ শব্দের অর্থ তখনো বুঝতে শুরু করিনি। দলবল নিয়ে পাশের জংগলে চলে যেতাম। দলবলের সামনে সেই ছোটবেলায় একদিন ঘোষণা করেছিলাম বড় হয়ে নিরামিষাশী হয়ে যাব। ত্যাগ কি সেটা এখন বুঝতে শিখেছি,তবে নিরামিষাশী হওয়াটা আর হয়ে ওঠেনি,হয়ত বড় হওয়াটাও।’

তারেক মুসা
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ , ঢাকা কলেজ

‘ঈদ খুব সাধারনভাবেই কেটে যায়। ঘুম থেকে ওঠা, ছোট ভাইকে নিয়ে ঈদগাহে যাওয়া। দুপুরে কুরবানির গোশত খাওয়া । বিকেলে হয়ত বন্ধুদের বাসায় কিংবা আত্মীয়ের বাসায় যাওয়া । আর স্মৃতি রয়ে গেছে অনেক; ঈদের তৃতীয় দিন গরু কিনে কুরবানি দেয়া, গরুর আধা জবাইয়ের পর সাই করে দাঁড়িয়ে যাওয়া ইত্যাদি । আর প্রিয়দের আনন্দ পেতে দেখাটাই আমাদের আনন্দ পাবার খোরাক হয়ে গেছে , এইতো ।’

 

 

নিজাম সরকার সাইফ
সমাজকর্ম বিভাগ , জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

‘কুরবানি ঈদ নিয়ে বেশ ভাবিত আমি। ঈদের মাসখানিক আগ থেকেই গরু নিয়ে আমার ভাবনা শুরু হয়। প্রায় প্রতিদিন হাটে যাই , ঈদের আগে ঢাকার প্রায় সব বড় গরুর হাটেই আমার ঘুরা হয়ে যায়। আমাদের গরু কিনবার পর থেকে প্রায় সারা দিন কাটে আমার গরু নিয়ে, গরুকে খাওয়ানো, গোসল করানো এসব করে।  ঈদের দিন জবেহ করার সময় আমি আর সামনে থাকতে পারি না, কষ্ট হয় খুব, মায়া জমে যায়। তারপর বিকেলে বন্ধুদের সাথে ঘোরাফেরা, আত্মীয়দের বাসায় যাওয়া হয়। আর ঈদে খাওয়া হয় প্রচুর।’