রক্তাক্ত কারবালা : চেতনা ও শিক্ষা

মুহা. হাফিজুর রহমান

শুরুর শুরু:

ইতিহাস শিক্ষিতজনদের উৎকৃষ্ট খোরাক। বুদ্ধিমানদের পথের পাথেয়। জ্ঞানীদের চলার বাহন। বিবেকবানরা ইতিহাস পড়েন। অতীতের ঘটনাবলী থেকে শিক্ষা নেন। আগামীর কর্মপন্থা ঠিক করেন। ইতিহাস হয় নানান রকমের। উত্থান -পতনের, যুদ্ধ -বিগ্রহের, সুখ-দু:খের। কিন্তু ৬১ হিজরীর ১০ মুহররম কারবালার যমীনে যে ইতিহাসের জন্ম হয়েছিলো, সে ইতিহাস বড় নির্মম। সে ইতিহাস খুব করুণ। মানবতা সেদিন গড়াগড়ি দিয়ে কেঁদেছিলো ফুরাতের তীরে। সে ইতিহাস পাষাণের চোখেও জল এনে দেয়।

খেলাফতের প্রশ্ন :
৬০ হিজরী। মুসলিম জাহানের বৃহৎ একটি অংশ ইয়াযিদকেই খলিফা হিসেবে মেনে নিলো। ইয়াযিদের দূত এলো মদীনায়। তার পক্ষ হতে মদীনাবাসীর বাইয়াত গ্রহণের জন্য। হযরত হোসাইন রাঃ, আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাঃ সহ আরো অনেকেই বাইয়াত হতে অস্বীকার করলেন। তাঁদের দাবি, মুসলিম জাহানে ইয়াযিদের চেয়ে যোগ্যতর ব্যক্তি এখনো বর্তমান। তাঁদের এ অস্বীকৃতি যখন জোর থেকে জোরালো হচ্ছে, কুফা থেকে তখন চিঠি এলো হোসাইন রাঃ এর কাছে। শত শত চিঠি। চিঠির ভাষ্য- খেলাফতের প্রশ্নে কুফাবাসী হোসাইন রাঃ এর হাতে বাইয়াত হতে চায়। তিনি যেন কুফায় চলে আসেন। ইয়াযিদকে তারা খলিফা মানেনা।

কুফার পথে ইমাম হোসাইন (রাঃ):
কুফাবাসীর এ আহবান তিনি সরলচিত্তে গ্রহণ করলেন। চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকীলকে তিনি কুফায় পাঠালেন, পরিস্থিতি যাচাই করতে। মুসলিমের ইতিবাচক পত্র পেয়ে সঙ্গী-সাথীসহ তিনি কুফার পথে যাত্রা করলেন। কিন্তু নিয়তি ছিলো অন্য রকম। হঠাৎই কুফার হাওয়া বদলে গেলো। ইয়াযিদের একান্ত বাধ্যগত উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ এলো কুফার গভর্ণর হয়ে। রাতারাতি কুফাবাসীর সুর পাল্টে গেলো। হত্যা করা হলো মুসলিম ইবনে আকীলকে। বিশ্বাসঘাতকতা করা হলো নবী দৌহিত্রের সাথে!

তাই বলে কি শুধু দিনভর কেঁদেই ফিরবো? নিজের দেহ কেটে-ছিড়ে শোক পালন করবো? কিংবা বর্ণাঢ্য মিছিল, শোক র‍্যালি আর হৃদয় বিদারক শোকগাঁথা গেয়ে বেড়াবো? আসলে এসবের কোন মূল্য নেই। চাই তো আত্মত্যাগ। চাই বুকভরা সাহস, পাহাড়সম হিম্মত। প্রয়োজন ইসলামের স্বার্থে নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়ার মানসিকতা।

শাহাদাতে হোসাইন( রাঃ):
সা’লাবিয়া নামক স্থানে পৌঁছে হোসাইন রাঃ কুফাবাসীর বিশ্বাসঘাতকতার কথা জানতে পারলেন। তিনি সঙ্গীদেরকে বললেন, কুফাবাসী কথা রাখেনি। কাজেই যারা ফিরে যেতে চাও, খুশি মনে ফিরে যেতে পারো। সবাই ফিরে গেলো। রয়ে গেলো শুধু পরিবারের সদস্যবর্গ ও নিবেদিতপ্রাণ বিশ্বস্ত কিছু সহচর। এর পরের ইতিহাস নির্মম। সে ইতিহাস কান্নার।

বিভিন্ন ঘটনার অলিগলি মাড়িয়ে অল্প কিছু সঙ্গী-সাথি নিয়ে তিনি উপনিত হলেন কারবালা প্রান্তরে। সেখানেই অবরুদ্ধ করে দিলো তাকে হুর ইবনে ইয়াযিদের ১০০০০ সৈন্যের সশস্ত্র বাহিনী। হোসাইন রা: ইয়াযিদের সাথে সরাসরি কথা বলতে চাইলেন, প্রত্যাখান করা হলো। তিনি মদীনায় ফিরে যেতে চাইলেন, তাঁর পথ রূদ্ধ করা হলো। অন্য কোথাও চলে যেতে চাইলেন, সে সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করা হলো। খাদ্য নেই। পানি নেই। যুদ্ধের রসদ নেই। তবুও তাঁকে লড়তে হলো। তিনি লড়লেন ৭২ জন সঙ্গী নিয়ে। লড়লেন বীরের মতো। হায়দারী রক্ত যে অন্যায়ের সাথে আপোষ করতে জানেনা! লড়াই হলো, প্রচণ্ড লড়াই। একে একে সবাই শহীদ হলেন। সিংহ শার্দূল ইমাম হোসাইন রা: তখনো জীবিত। নি:সঙ্গ একা। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত। পিপাসায় কাতর। তাঁর তলোয়ারের তেজ দেখে দেখে শত্রুরা হয়রান! হঠাৎই হোসাইন ইবনে তামীমের নিক্ষিপ্ত তীর এসে বিঁধলো তাঁর কণ্ঠণালীতে। আরয়া বিন শুরাইক তাঁর উপর তরবারীর আঘাত হানলো। সিনান ইবনে আনাস বর্শার আঘাতে তাঁকে যমীনে শায়িত করে ফেললো এবং তরবারী দিয়ে মস্তক মুবারক দ্বিখণ্ডিত করে ফেললো!

জালিমের কালো হাতে ইতিহাসের পাতায় যুক্ত হলো আরেকটি কালো অধ্যায়। আহ! ধিক তোদের, শত ধিক!

দোয়াই হোক প্রথম সবক:
সেই ৬১ হিজরীর পর আজ পর্যন্ত কত মুহররম এলো গেলো! কত আশুরা জীবন থেকে গত হলো! আমাদের চেতনার বাতিঘরে কত রঙিন বাতিই না জ্বললো-নিভলো! কিন্তু সত্য করে বলুন তো, ক’জন কয়দিন আমরা হাত তুলে দোয়া করেছি কারবালার সেই মজলুম শহীদদের জন্য? কয়দিনই বা রব্বে কারীমের সমীপে চোখের পানি ঝরিয়েছি ইমাম হোসাইন রাঃ ও তাঁর সঙ্গীদের জন্য?

অন্যায়কে না বলুন:
কারবালার ঘটনা থেকে শেখার আছে অনেক কিছুই, যদি আমি শিখতে চাই। এই যে ফাতেমা রাঃ এর আদরের দুলাল ফুরাতের তীরে জীবন বিলিয়ে দিলেন, কেন? ক্ষমতার মোহ তো তাঁর ছিলো না। শাসক হওয়ার স্বপ্নও তিনি দেখেননি। তাহলে? হ্যা, খেলাফতের পবিত্র মসনদে ‘তখনকার’ ইয়াযিদ ছিলো বেমানান। তাঁর চোখে ‘তখনকার’ ইয়াযিদের এ পবিত্র মসনদে আরোহণ ছিলো অন্যায়। তিঁনি তার প্রতিবাদ করেছেন। জীবন দিয়েছেন। অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেয়ার এ শিক্ষা আমরা যদি কবুল করতাম, তাহলে যুগে যুগে জালিম শাহীর অত্যাচারের খড়গ থেকে আমরা নিস্তার পেতাম।

আসুন, বাতিলের সামনে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াই:
বাতিল সেদিনও ছিলো। আজো আছে। কুল কায়েনাত যতদিন টিকে থাকবে, বাতিলও ততোদিন বেঁচে থাকবে। সেক্ষেত্রে আমাদের করণীয় তাই, যা ইমাম হোসাইন রাঃ সেদিন কারবালা প্রান্তরে করেছিলেন। তিনি বাতিলের সাথে আপোষ করেন নি। বাতিলের সামনে মাথা নত করেন নি। আসুন, এ থেকে শিক্ষা নেই। বাতিলের সামনে নতজানু হয়ে বসার অভ্যাস ছাড়ি। মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াই। প্রতিজ্ঞা করি “শির দেগা, মাগার নেহি দেগা আমামা”।

ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহিনা:
কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনায় ব্যথিত হয়না-এমন পাষাণ বোধহয় নেই। আমরাও ব্যথিত হই। তাই বলে কি শুধু দিনভর কেঁদেই ফিরবো? নিজের দেহ কেটে-ছিড়ে শোক পালন করবো? কিংবা বর্ণাঢ্য মিছিল, শোক র‍্যালি আর হৃদয় বিদারক শোকগাঁথা গেয়ে বেড়াবো? আসলে এসবের কোন মূল্য নেই। চাই তো আত্মত্যাগ। চাই বুকভরা সাহস, পাহাড়সম হিম্মত। প্রয়োজন ইসলামের স্বার্থে নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়ার মানসিকতা।

শেষ কথা:
হোসাইন রাঃ কারবালায় শাহাদাত বরণ করেছেন। তাঁর আদর্শ শহীদ হয়ে যায়নি। তাঁর চেতনা তাঁর সাথে দাফন হয়ে যায়নি। তাঁর দেখানো পথ ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যায়নি। আসুন, সেই পথে হাটতে শিখি। যদিও সে পথ বড় দুর্গম, কণ্টকাকীর্ণ। আল্লাহ আমাদের সহায় হোক।

আরো পড়ুন পোস্ট করেছেন

Comments

লোড হচ্ছে...
শেয়ার হয়েছে