শিশুদের সামনে কুরবানি; লাভ লোকসানের হিসাব

হাসান মাহমুদ

ইসলাম তথা মুসলিম সংস্কৃতির অন্যতম বড় উৎসব হলো ঈদ-উল-আযহা। পশু কুরবানির মধ্য দিয়ে প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মুসলমান আপন সত্ত্বার পশুত্বকে কুরবানি করে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করে। কিন্ত প্রশ্ন উঠে আসে- শিশুদের সামনে পশু জবেহের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে। বলা হয়ে থাকে এই জবেহের চিত্র শিশু মনে বিরূপ প্রভাব ফেলে শিশুদের সুস্থ মনস্তাত্বিক বিকাশ-এ বাঁধা দেয়। আসুন জীবন থেকেই এর উত্তর খুজে নেই।

প্রথমত, আল্লাহ ভালো জানেন জবেহের মত দৃশ্য শিশুমনে প্রভাব ফেলবে কীনা। আর ফেললেও সেটা কতটা, এর ভালো কিম্বা খারাপ প্রভাব সম্পর্কে তিনি অবগত আছেন। সবকিছু জেনে-বুঝেই অত্যন্ত সতর্কভাবে তিনি এ বিধান দিয়েছেন। আর এ বিশ্বাস থাকা একান্ত শর্ত।

দ্বিতীয়ত, সত্যিকার ধর্মীয় মূল্যবোধ শিশুমনকে বর্বর বা হিংস্র নয়, ধার্মিক করে তোলে। আর এ কথা প্রমাণের জন্য আল্লাহ তায়ালা ইসলামের ইতিহাসের প্রথম কুরবানীতে এক শিশু ইসমাইলকে (আঃ) সাক্ষী রেখেছিলেন। ইতিহাস সাক্ষী- সে দৃশ্য তাকে বর্বর নয়, আল্লাহর মাহাত্ম্য ও প্রশংসার প্রতিই উদ্বুদ্ধ করেছিল।

তৃতীয়ত, পশু কুরবানীর মধ্য দিয়ে স্রষ্টার নৈকট্য অর্জন কোনো নতুন বিষয় নয়। ইসলাম ছাড়া অন্যান্য ধর্মেও বলি দান প্রথা বিদ্যমান। আর সে সকল প্রথা শিশু-বৃদ্ধ সকল বয়সের মানুষ উদযাপন করে থাকে। তবু প্রশ্ন শুধু মুসলমানদের একদিনের উৎসবকে কেন্দ্র করে ওঠা কতটা যুক্তিসঙ্গত?

কোন ধর্মকে আঘাত দিয়ে নয়- এই বিশ্বাস রাখা জরুরী যে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান রীতিনীতি মানবজাতির কল্যাণের জন্য, ক্ষতির জন্য নয়।

চতুর্থত, শিশু যখন স্বশরীরে ধর্মীয় রীতিনীতি পালনে অগ্রসর হবে, তখন তার মাঝে আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের আলো জ্বলে উঠবে- যেখানে বর্বরতার কোন স্থান নেই। শিশু যখন তার অবিভাবককে একনিষ্ঠভাবে ধর্মীয় আচার পালণ করতে দেখবে, তখন তার ভেতর কুরবানির বীভৎসতা নয়, মহিমা ফুটে উঠবে। তার মনে সমস্ত সৃষ্টিকূলের প্রতি এক মায়ার জন্ম হবে যা তাকে আদর্শ মানুষে পরিণত হতে সাহায্য করবে।

পঞ্চমত, একটি সহজ যুক্তি। খেয়াল করুন- আজকের সমাজে যতো সভ্য ও সুশীল মানুষ রয়েছেন, তারাও কুরবানি করছেন এবং শিশুকালে কুরবানি দেখেই বড় হয়েছেন। তারা কি তাহলে বর্বর হচ্ছেন বা হয়েছেন? তারা কি হিংস্রতায় অভ্যস্ত হয়ে আছেন? প্রশ্নটার জবাব বড় গুরুত্বপূর্ণ।

তবে হ্যা, মানব মন সবার একরকম নয়। সবাই সব জিনিস সহজে নিতে পারেনা। আজকাল সমাজে সাউন্ড ফবিয়া, হাই ফবিয়া ইত্যাকার নানান ফবিয়া আছে যা মানুষের সাইকোলোজির সাথে সম্পৃক্ত। এহেন অবস্থায় কুরবানির মত আমলে যদি তার কোন ফবিয়া হয় সেক্ষেত্রে তো সে মানুষটাকে নিরাপদ রাখতেই হবে। চাই সে শিশু হোক অথবা বয়স্ক হোক। এ কারনে সর্বসমক্ষে কুরবানি করার ব্যাপারে সামগ্রিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের মনোভাব কল্যাণকর নয়।

মনে রাখতে হবে, প্রতিনিয়ত হিংস্র ও বর্বরতার খবরে যেমন পত্রিকা ভরা থাকে, ঠিক তেমনি টিভিতেও দেখানো হয়। এছাড়া প্রতিনিয়ত ক্রাইম সিরিয়ালও হয়। সবচেয়ে বড় কথা- ইন্টারনেট জগতে এর কিছুই লুকোনো থাকে না। আর শিশুরাতো এগুলোর সঙ্গে খুবই সম্পৃক্ত। একদিনের একটা কাজের ক্ষেত্রে আমরা রব তুলছি কিন্তু শিশুটি প্রতিনিয়ত এই ধরনের সিনারিওর সাথে পরিচিত হচ্ছে। অথচ আমরা বেখবর।

অতএব, শিশুমনে বিরূপ প্রভাবের দায়ভার কোনো ধর্মীয় রীতিনীতির নয়, এ দায়ভার আমাদের। আমরাই শিশুমনে অমানবিকতা চিত্রায়ন ও দৃশ্যায়ন করে যাচ্ছি অহরহ। আমাদের সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রে আজ যে অমানবিকতার ছোঁয়া, এর দায়ভার একদিনের আচার সর্বস্ব অনুষ্ঠানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া শাক দিয়ে মাছ ঢাকা ছাড়া আর কিছু নয়।