উপন্যাসিকা: দ্য কালেকশন

সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর

মুফতি আবদুল হাকিম ফারুকী ঘরের বারান্দায় বসে আছেন। ঘরের ভেতর থেকে ঘর গোছানোর টুকটাক শব্দ আসছে। মুফতি সাহেব গভীর মনোযোগ দিয়ে টুকটাক শব্দ শুনছেন। তার মনে হচ্ছে, কতোদিন পর তিনি এমন মধুর শব্দ শুনতে পাচ্ছেন।
নারী জিনিসটা আল্লাহপাকের এক আজব সৃষ্টি- বসে বসে ভাবছেন মুফতি সাহেব। তার স্ত্রী আয়েশা ঘর গোছাচ্ছে, বিছানার চাদর পাল্টাচ্ছে, মেঝে ঝাঁট দিচ্ছে- বারান্দায় বসে এসব শুনতেও তার ভালো লাগছে। আধঘণ্টা হবে সে এসেছে, দুটো ঘর আর একটা বারান্দা নিয়ে ছোট্ট বাড়িটা এরই মধ্যে আয়েশা আয়েশা গন্ধে ভরে গেছে। ঘরের প্রতিটা দেয়াল, আসবাব, দরজা-জানালা, কাপড়-চোপর যেনো খুশিতে খলবলিয়ে উঠছে। তারও খুব ইচ্ছে করছে আয়েশার সঙ্গে হাত লাগিয়ে ঘরদোর গুছিয়ে দেয়, কিন্তু ও জোরে ধমক দিয়ে তাকে এখানে বসে থাকতে বলেছে। যে পর্যন্ত তার ঘর গোছানো শেষ না হবে ততোক্ষণ এখান থেকে নড়াচড়াও নিষেধ।

ঘরের ভেতর থেকে আয়েশা কপট বিরক্ত সুরে বলে উঠলো, বিছানার এই অবস্থা করছেন ক্যামনে? বিছানায় কি কোনো পরী টরী নিয়া আসছিলেন নাকি?
মুফতী সাহেব হেসে ফেললেন, আস্তাগফিরুল্লাহ! কী আজগুবি কথা যে তুমি কও না!
-: আনতেও পারেন। আমি দুই সপ্তাহ ছিলাম না, এর মধ্যে কাউরে আনলে কে জানবো!
-: উফফ… আস্তা একটা মাথা খারাপ মহিলা তুমি।
-: আমার মাথা যে কিঞ্চিত খারাপ, এইটা আপনে বিয়ার আগেই টের পাইছিলেন। এ কারণেই তো আমারে বিয়া করতে এতো উতলা হয়া গেছিলেন। এইডা আমি ভালো কইরাই জানি।
-: হ, কইছে তোমারে!
-: আচ্ছা মুফতি সাব, আপনে একটা ভ্যাবদা টাইপের লোক হইয়া আমার মতো এমন মাথা খারাপ মাইয়ারে বিয়া করতে চাইলেন কোন কারণে? সত্যি কইরা কন তো?
মুফতি সাহেব বারান্দা থেকে উঠে ঘরের দরজার সামনে গিয়ে অসহায় সুরে বললেন, আয়েশা, পাগলামীটা এইবার বন্ধ করো!
-: মিস্টার মুফতি সাব, ভালোবাসা জিনিসটাই হচ্ছে পাগলামী। যার ভালোবাসার মধ্যে পাগলামী নাই, সে সত্যিকারের ভালোবাসতে পারে না। ভালোবাসা পায়ও না। কালকে যে আপনে আমারে আনতে রাইতের বেলা পাগলের লাহান ছুইটা আমার বাপের বাড়ি গেছিলেন, ক্যানো গেছিলেন?
মুফতি সাহেব কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। আমতা আমতা করে বললেন, গেছিলাম… , যায় না মানুষ শ্বশুরবাড়ি… কতোদিন পর, এই কারণে… ক্যান আবার!
আয়েশা ফিক করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতেই আলনার কাপড়গুলো ভাঁজ করে বিছানায় এসে বসলো। তার কপাল ঘামে ভিজে গেছে, ঠোঁটের উপরও জমে আছে ঘামের বিন্দু। মুফতি সাহেব দরজায় দাঁড়িয়েও ওর জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা ঘামের বিন্দু স্পষ্ট দেখতে পেলেন। এই ঘাম যদি তার তার ঠোঁটের উপর হতো, কী বিশ্রীই না লাগতো। অথচ আয়েশার ঠোঁটের উপর কী অদ্ভুত সুন্দরভাবে মানিয়ে গেছে।
-: অমনে তাকায়া আছেন কেন? এইদিকে আসেন। দরজায় দাঁড়ায়া দাঁড়ায়া ইভটিজিং করা ভালো না।
মুফতি আবদুল হাকিম ফারুকীর খুব ইচ্ছা হলো হো হো করে হেসে উঠতে। হাসতে হাসতে খুব জোরে চিৎকার করে বলতে চাইলেন- এই কারণে, শুধু তোমার এমন পাগলামীর কারণেই তোমাকে বিয়া করছিলাম।

দুই
বাজারে যাওয়ার পথে পুবপাড়ার আজগর আলি মহাজনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। গেরস্থ মানুষ, অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। নামাজ-রোজায় যেমন পাবন্দ তেমনি দান-খয়রাতেও হাত দারুণ দরাজ। ফুলতলী মাদরাসায় প্রতি মাসে আট-দশ বস্তা চাল তার দোকান থেকে আসবেই। তাছাড়াও মাদরাসার দু’জন ছাত্র তার বাড়িতে নিয়মিত লজিং থাকে।
মুফতি সাহেবকে আসতে দেখেই তিনি এগিয়ে এলেন, আসসালামু আলায়কুম বড়হুজুর, বাজারে যান নাকি?
-: ওয়ালাইকুম সালাম, জি মহাজন চাচা!
মাদরাসার মুহতামিম হিসেবে এলাকার গণ্যমান্য লোকজনের সঙ্গে সদ্ভাব রাখা তার অন্যতম গুরুদায়িত্ব। সবার মন যুগিয়ে চলতে হয়। কিন্তু আজগর আলি মহাজন অন্যরকম, তার সঙ্গে কথা বলতে মুফতি সাহেবের বরাবরই ভালো লাগে। তার বাড়িতে গেলে কখনো খালি হাতে আসতে দেন না। পরিবারের জন্য কোনো ফল, নয়তো রান্না করা দু-এক পদের তরকারি, বা দু-এক কেজি রাজভোগ চাল দিয়ে দিবেনই। এ কারণে লজ্জায় তিনি মহাজনের বাড়ির দিকে যান না বড়জোর। তবুও মহাজন মাঝেমধ্যেই বড়হুজুরকে জোর করেই ধরে নিয়ে যান।
আজগর আলি মহাজন মুফতি সাহেবের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বলতে লাগলেন, আমিও বাজারে যাইতেছি। ছোট নাতিটার দুই দিন ধইরা জ্বর, কিচ্ছু মুখে দেয় না। আইজকা বায়না ধরছে খেজুরের গুড় দিয়া মাখায়া দুধ-ভাত খাইবো। কন তো, এই জৈষ্ঠ্য মাসে খেজুরের গুড় কই পাই?
-: খেজুরের গুড় পাওন তো কষ্ট হইয়া যাইবো।
-: যাই দেখি, সোবহানের দোকানে পাওন যাইতে পারে। না পাইলে সদরে যাওন লাগবো। জ্বর নিয়া নাতিটা খাইতে চাইতাছে, না খাওয়াইতে পারলে অন্তরটা শান্তি পাইবো না।
-: জি, তা তো ঠিকই।
-: শোনলাম, বিবি সাব নাকি আইছে?
-: জি, সকালে নিয়া আসলাম।
-: হেহেহে… ভালো কাম করছেন। এই বয়সে বউ ঘরে না থাকলে দুনিয়াদারি তো দুনিয়াদারি, এবাদত-বন্দেগিও ঠিকমতো হয় না। কী কন হুজুর? মুফতি সাহেবকে প্রশ্ন করে আজগর মহাজন আরেকবার হেসে নেয়।
মুফতী আবদুল হাকিম ফারুকী এমনিতেই লাজুক মানুষ, দশ কথার জবাব দেন তিনি দু’ কথায় । আর এমন রসালো বিষয়ে তিনি বরাবরই নতমুখী। মুচকি হেসে মাথা নিচু করে ফেললেন।

তিন
বাজারে ঢুকতেই দক্ষিণ ফুলতলীর হোসেন মিয়া এগিয়ে আসে- মহাজন সাব, কামলা নিছেন নাকি আইজকা?
-: আরে রাখো তোমার কামলা, ছয়শো-সাড়ে ছয়শো ট্যাকা কইরা কামলার রোজানা কি তোমার বাপে দিবো? ধান কাটা তো এহনও লাগেই নাই, এহনই যদি ছয়শো কইরা কামলা নিতে হয় তইলে আর  দিন ত পইড়াই রইছে। তহন তো সাতশো-আটশো কইরা কামলা নিতে হইবো। তহন কী করুম?
-: আর কয়েন না মহাজন সাব, আমার তো আইজকা কামলা আনতে গিয়া মাথা ঘুরানি লাগতাছিলো। মনে হইতাছিলো কামলাগো সামনেই ঘুরাণ্টি দিয়া পইড়া যামু। ছয়শো বিশ টাকা দাম শুইনা ছাতাডা কান্ধে ফালায়া হনহন কইরা হাইট্টা আইসা পড়ছি। পিছনে আর ফির‍্যা তাকাই নাই।
-: ধান চাষ কইরা কি যে বিপদে পড়ছি! ধানের দাম মাত্র ছয়শো টাকা মণ। এহন কামলার যে দাম, তাতে ধান বেচার ট্যাকা দিয়া তো কামলাগো রোজা-ই দেওন যাইবো না। ধান বোনা বাদ দিমু!
আজগর মহাজনের কণ্ঠে হতাশা ঝরে পড়ে। এ অঞ্চলের সবচে অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ তিনি, এক নামে সবাই চেনে। প্রায় সাত-আটশো ডিসিমেল জমিতে ইরি ধানের চাষ করেন। প্রতিবছর পাঁচশো মণের ওপরে শুধু ইরি ধান গোলায় তোলেন তিনি। কিন্তু গত দু-তিন বছর ধরে ধান বোনা আর কাটার সময় ক্ষেতশ্রমিকের দাম যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, তাতে ধান বুনে লাভের চেয়ে ক্ষতিই হচ্ছে। জমিচাষ, ধানের চারা রোপন, নিয়মিত ডিপমেশিন দিয়ে পানি সেচ, ক্ষেতের আগাছা নিড়ানি, সার-বিষ আর ধানকাটার পেছনে যে খরচ হয়, সবশেষে হিসাব করে দেখা যায় মণপ্রতি ধানের দামের চেয়ে খরচই বেশি পড়ে যায়।
হোসেন মিয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতে সামনে এগিয়ে যান আজগর মহাজন।

***
তরি-তরকারি কিনে মাছহাটায় এসে একটু চুপসে যান মুফতি সাহেব। আয়েশার পছন্দের পাঙ্গাশ মাছ নেই বাজারে, সব ছোট মাছ। ছোট মাছের যে দাম তাতে তো পকেটে কুলোবে না মনে হচ্ছে। তিনি মাছহাটায় দাঁড়িয়ে আগুপিছু করতে করতেই পেছন থেকে আজগর মহাজন এসে পড়েন- হুজুর, মাছ কিনা হইছে নাকি?
-: জি না।
-: কী মাছ নিবেন?
-: জি আপনাদের বউমা পাঙ্গাশ মাছ পছন্দ করে। কিন্তু বাজারে তো আইজকা পাঙ্গাশ দেখতেছি না।
-: পাঙ্গাশ পছন্দ করে, ঠিক আছে। তাই বইলা অন্য মাছ তো অপছন্দ করে না। পাঙ্গাশ মাছে কাঁটা থাকে না তাই সবাই পাঙ্গাশ খাইতে চায়। মেয়েমানুষ এমনে পেঁচিল্যা হইলে কী হইবো, খাওনের সময় কাঁটা-কুটার প্যাঁচানি ভালো পায় না।
এ কথা বলেই তিনি সামনে মাছের খাঁড়ি নিয়ে বসা জেলের প্রতি হাঁক ছাড়েন- ওই নিতাই, তোর বাতাসী কতো কইরা রে?
-: জি মহাজন সাব, সাড়ে তিনশো কইরা।
-: চোপড়ায়া তোর দাঁত ফালায়া দিমু। তিন দিন আগের মাছ, মইরা কুয়্যা হইয়া গেছে, এগলা সাড়ে তিনশো!
-: কী কন মহাজন সাব, সকালে মাওয়া থেকা নিয়া আইছি। আপনে একটা মাছ ধইরা দেখেন, এক্কেরে টাটকা।
-: রাখ তোর টাটকা। আড়াইশো টাকা কইরা দুই কেজি মাপ।
-: মাফ চাই, তিনশো ট্যাকার কমে দিতে পারুম না মহাজন সাব।
-: কথা বাড়াইস না, দুই পলিথিনে দুই কেজি মাছ দে। ট্যাকা সাড়ে পাঁচশো আমাগো দোকান থিকা নিয়া যাইস।
নদীর জ্বলজ্বলে বাতাসী মাছ কিনে এক কেজি জোর করে মুফতি সাহেবের বাজারের ব্যাগে ভরে দেন আজগর মহাজন। মুফতি সাহেব সঙ্কোচে জেরবার হয়ে যান। তার বাবা নেই, বাবা মারা গেছেন ছোটবেলায়ই। অনেক দুঃখ-কষ্টে মানুষ হয়েছেন। বাবার বয়সী আজগর মহাজনের এমন প্রাণখোলা ব্যবহারে তার বাবার কথা মনে পড়ে যায়। চোখ জল চলে আসে মুফতি আবদুল হাকিমের।
ফেরার পথে এটা সেটা নিয়ে কথা বলতে বলতে মুফতি সাহেব বলেন, চাচা, একটা কথা বলতে চাই।
-: বলেন বলেন…।
-: এই যে আপনেরা ধান চাষ করেন, যা শোনলাম- ধান চাষ কইরা এখন তো লাভের চাইতে ক্ষতিই বেশি। সবকিছুর দাম যে হারে বাড়তাছে, কিন্তু ধানের দাম তো সেভাবে বাড়তাছে না। তাইলে ধান চাষ না কইরা অন্য কিছু চাষ করেন, যেইটা চাষ করলে লাভ হইবয়।
-: হুজুর, আপনে তো ট্যাঙ্গর এলাকার লোক। ধানের কী মহত্ব এইটা আপনে বুঝবেন না। আগামীতে এখনকার চাইতে ডাবল খরচও যদি হয় তবুও মাইনষে ধানই বুনবো। কেন জানেন?
-: কেন?
-: ধানের প্রতি ভালোবাসা। ধান না বুনলে মাইনষে খাইবো কী? ষোল-সতেরো কোটি মানুষ আমাগো এই ছোট্ট দেশে, এতো মানুষের খাওন যোগানোর লাইগা কতো ধান দরকার, সেইটা কী কখনো চিন্তা করছেন? এই কৃষকরা যদি ধান না বুনে তইলে সারা দেশের মাইনষের তো ভুট্টা-গম খাইয়া বাঁচন লাগবো।
-: সেইটা ঠিক আছে, কিন্তু এমন লস দিয়া ধান বুইনা কতোদিন চলতে পারবো কৃষকরা?
-: সেইটা আল্লায়ই ব্যবস্থা করবো। এ বছর কামলার দাম বেশি ধানের দাম কম, সামনের বছর হয়তো ধানের দাম বাড়তেও পারে।
-: কিন্তু অনেক গরিব কৃষকেরই তো এ বছর মাথায় হাত। তাগোর সম্বলই তো দুই-চাইরটা ক্ষেত। সেগুলার ধান কাইটা গোলায় তুলতে যদি হাজার হাজার ট্যাকা লাগে, তইলে তো তাগোর পথে বসনের মতন অবস্থা হইবো।
-: হুমম… চিন্তার বিষয়। আমারই তো মনে হয় লাখখানেক টাকার বেশি লাগবো শুধু কামলার পিছনে।
-: তাইলে বুঝেন অন্যগোর কী অবস্থা হইবো!

চলবে ইনশা-আল্লাহ্…

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

তৃতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।