লেখক: ক্রিস্টিন এন্ডারসনের গল্প অবলম্বনে
অনুবাদ : মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
দু’জন দর্জি এক শহরে গিয়ে সেখানকার রাজাকে প্রতারিত করে। রাজার কাছে গিয়ে তারা বললো, আমরা দু’জনই দক্ষ দর্জি। অভিজাত শ্রেণী আর রাজা-বাদশাহদের পোশাক তৈরিতে আমাদের জুড়ি নেই। আমরা পোশাক সেলাই করি তাদের শরীরের ঠিক মাপমতো। একেবারে দৃষ্টিনন্দন। তবে আমাদের সবচেয়ে বড় নৈপুণ্য হচ্ছে আমরা মহামান্য রাজার জন্য এমন পোশাক সেলাই করতে পারি, যা কেবল মা-বাবার বৈধ সন্তান হালালযাদারাই দেখতে সক্ষম হবে। অবৈধ জারজ সন্তানরা তা দেখতে পাবে না। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আপনার জন্যও আমরা এরূপ একজোড়া কাপড় সেলাই করে দেবো। রাজা সন্তুষ্ট মনে সায় দিলেন। নির্দেশ দিলেন : এ দু’দর্জিকে অঢেল স্বর্ণ-রৌপ্য দেয়া হোক, এগুলো দিয়ে তারা মহামান্য রাজার জন্য সেই জাদুর পোশাক তৈরি করবে। স্বর্ণ, রৌপ্য, মণি-মুক্তার নিপুণ বুননে তৈরি করবে এই পোশাক।
দর্জিরা রাজ দরবার থেকে টাকা-পয়সা, স্বর্ণ, রৌপ্য, হীরা, জহরত নিয়ে একটি বিশাল কারখানা গড়ে তুললো। সেলাই মেশিন, কাচি, সুইসহ নানা আয়োজন গড়ে তুললো সেই সেলাই কারখানায়। কিন্তু তারা কোনো কাপড়ে, স্বর্ণ, রৌপ্য বা হীরা-জহরত ব্যবহার করতো না। তাদের হাতগুলো উপরে তুলে এমনভাবে ঘোরাতো যাতে দেখে মনে হতো যে তারা সেই জাদুর পোশাক তৈরিতে ভীষণ মশগুল।
একদিন রাজা প্রধান উজিরকে পাঠালেন, পোশাক নির্মাণের অগ্রগতি দেখার জন্য। মন্ত্রী প্রবর কারখানায় গিয়ে যতোই চেষ্টা করলেন কিছুই দেখতে পেলেন না। কিন্তু মনে ভয় জাগলো, অন্যরা হয়তো বুঝতে পারবে যে প্রধানমন্ত্রী জারজ-সন্তান, তাই তিৃনি রাজার পোশাক দেখতে পাচ্ছেন না। কাজেই তিনি জোর গলায় প্রশংসা শুরু করলেন পোশাকের আর দর্জি দু’জনের নৈপুণ্যের। রাজার কাছে এসে তিনি রিপোর্ট দিলেন জাহাপনা পোশাক তৈরির কার্যক্রম খুব সুন্দরভাবে এগুচ্ছে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা পোশাক বুনন কারখানা পরিদর্শনে যান। তারাও জারজ সন্তান হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ভয়ে এই তিক্ত সত্যটি গোপন করে সবাই মিছামিছি পোশাক বুননের অগ্রগতি, পোশাকের চোখ জুড়ানো বাহার বানিয়ে পরস্পর প্রতিযোগিতায় লেগে যেতো। শেষ পর্যন্ত পালা এলো স্বয়ং রাজার। রাজা একদিন শাহী বুনন কারখানা পরিদর্শনে গেলেন। আজ তিনি স্বর্ণ ও রূপার সুতায় বানানো পোশাক পরবেন। কিন্তু তিনি পোশাক বলতে কিছুই দেখতে পেলেন না। মনে মনে বললেন, এতো মানুষের মধ্যে একমাত্র আমিই হয়তো বাবার বৈধ সন্তান হালালযাদা নই। না হয় সবাই দেখলো, আমি দেখছি না কেন? তার বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হলেও বিষন্ন মনে টক ঢেকুর তুলে বললেন, নাহ, পোশাক জোড়া খুব চমৎকার। নিপুণ হাতের স্পর্শে তৈরি কারুকার্য খচিত। আয়না সম্মুখে নিয়ে দাড়ালেন পোশাকের মাপ আন্দাজ সই করার জন্য। দর্জিরা একবার সামনে আরেকবার পেছনে আসে। অলীক পোশাক জোড়া রাজাকে পরিয়ে ঠিকঠাক করে দেয়। বেচারা রাজা দাড়িয়ে রইলেন উদোম গায়ে নেংটা। বদনামির ভয়ে কোনো কথা বলছেন না। এমন কি এমন জাদুর লেবাসের গুণকীর্তন বর্ণনায় পঞ্চমুখ হয়ে গেলেন তিনি। সন্তুষ্টি ও আনন্দ প্রকাশ করেন দর্জিদের শিল্প নৈপুণ্যে।
অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো শহরে এক বিশাল অনুষ্ঠান হবে। মহারাজা সেদিন জাদুর পোশাক পরবেন। স্বর্ণ, রৌপ্যের সুতায় হীরা জহরতে বোনা সেই পোশাকে বাদশাহকে এক নজর দেখবে দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা।
জনসাধারণ নিয়মমাফিক দাড়িয়ে রইলো রাস্তার দু’পাশে নির্দিষ্ট দিনে। রাজা এলেন অলীক পোশাক আসলে উদোম গায়ে, ন্যাংটা শরীর দিগম্বর। রাজকীয় ভঙ্গিতে ধীর পদক্ষেপে সম্ভ্রমে হাত নেড়ে এগিয়ে যাচ্ছেন জনতার মাঝপথ দিয়ে। দু’জন রাজভৃত্য সেই কাল্পনিক অলীক পোশাকের ঝুলন দু’হাতে তুলে ধরছিল, যেন ধুলায় কাদায় ধুলায়িত না হয় মহামান্য রাজার পোশাক। রাজ দরবারের সভাসদ, মন্ত্রী, আমীর, উচ্চপদস্থ রাজ কর্মচারীরা সম্মানে-সম্ভ্রমে বিস্ময়ে প্রশংসায়… কণ্ঠে রাজার পেছনে পেছনে হেটে চলেছেন। দু’পাশের অপেক্ষমাণ জনতাও কেউ রাজার পরনে কাপড় দেখলো না, কিন্তু জারজ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ভয়ে অনিচ্ছায় হলেও আনন্দ-ধ্বনি ঝরছিল। নতুন পোশাকের জন্য রাজাকে অভিবাদন জানাচ্ছিল রাজপথের বর্ণিল শোভাযাত্রায়।
হঠাৎ জনতার মাঝ থেকে একটি শিশু চিৎকার দিয়ে উঠলো। ওই যে রাজা। তার গায়ে যে কাপড় নেই। তিনি ন্যাংটা কেন? শিশুর মা যতোই ছেলেকে থামানোর চেষ্টা করলো : এমন লজ্জার কথা মুখে বলতে নেই। কিন্তু মা থামাতে পারলো না। শিশুটি এবার ভদ্রভাবে জানতে চাইলো মহামান্য বাদশাহ আজ ন্যাংটা কেন? ধীরে ধীরে আরো দু’একজন শিশুও কথাটি বলতে লাগলো। দেখতে দেখতে রাস্তায় দাড়ানো দর্শক সারির কেউ কেউ একই কথা বলতে লাগলো। ততোক্ষণে সমগ্র জনতা চিৎকারে ফেটে পড়লো : রাজা আজ ন্যাংটা কেন? কেন? কেন?
আজকের দিনে পাশ্চাত্য সভ্যতাও বোঝাতে চাচ্ছে, তারা মানুষের জন্য জাদুর পোশাক সেলাই করতে চায়, কিন্তু আসলে মানুষকে পোশাক পরানোর পরিবর্তে তাকে ন্যাংটো করে ছেড়েছে। এখন কারো সাহস নেই, চিৎকার দিয়ে বলবে পাশ্চাত্যের কাপড়-পোশাক বলতে কিছুই নয়। মডেল, ডিজাইন স্টাইল বলতে যা কিছু, কিছু নয়। মানুষকে ন্যাংটো করারই ব্যবসা।
আজ কি এমন মানুষ পাওয়া যাবে, যাদের মধ্যে শিশুসুলভ সততা আছে। যারা এমন এক বিশ্বের সম্মুখে দাড়িয়ে বুকভরা সাহস নিয়ে চিৎকার দেবে যে, বিশ্বে উলঙ্গপনাকে বলা হচ্ছে গায়ের বসন। এমন কাউকে কি পাওয়া যাবে, যে সততা ও সাহস নিয়ে বদনামির জড়তা ঝেড়ে উলঙ্গপনার সংস্কৃতি রুখে দাড়াবে। এই অশুভ অপচ্ছায়া যেন আর বেশি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পায়। উলঙ্গপনার সংস্কৃতির ছোবলে মানুষ তার প্রকৃত পরিচয় ও সত্তা যেন সম্পূর্ণ হারিয়ে না ফেলে।
সেই সাহসী মানুষ, আমরা মুসলমানরা কেন হবো না?
মহান সংস্কারক দার্শনিক কবি ও উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ চিন্তানায়ক আল্লামা ইকবালের ভাষায় – ফিরিঙ্গির শক্তি সে বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে সেই আগুনেই আলোকিত তার প্রদীপ জ্ঞান ও প্রযুক্তির জন্য হে প্রাণ – উচ্ছল যুবক মস্তিষ্কের প্রয়োজন, ফিরিঙ্গির পোশাক নয়। পশ্চিমি সংস্কৃতির সম্মুখে মুসলমানদের আত্ম-বিস্মৃত অবস্থার কারণেই আজ পাশ্চাত্যের বেশভূষা ধারণ করাকে উন্নতির সোপান মনে করা হচ্ছে। অথচ পাশ্চাত্যের উন্নতি ও প্রগতির মূলে রয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে যাওয়া, বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতাকে কাজে লাগানো এবং নিয়ম-শৃঙ্খলার কঠোর অনুশীলন। মুসলমানরাও যেমন শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল ধরে প্রায়োগিক ও অপ্রায়োগিক সব জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিশ্বসেরা ছিল। বস্তুত আল্লাহর দেয়া জ্ঞানশক্তি ও বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগানোর মাধ্যমেই প্রাচ্যের নামগুলো বিশেষ করে মুসলমানরা প্রগতিশীল হতে পারবে, পাশ্চাত্যের নগ্ন সংস্কৃতির পোশাক ও স্টাইলের অনুকরণের মাধ্যমে নয়। তাহলেই প্রাচ্যের মানুষ বিশেষত মুসলমানরা পাশ্চাত্যের অশ্লীলতা বেহায়াপনা ও তথাকথিত প্রগতির অশুভ প্রভাব থেকে রক্ষা পাবে।
Comments