উপন্যাসিকা: দ্য কালেকশন (তৃতীয় পর্ব)

সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর

ছয়

পরদিন ফজরের নামাজের পরপরই দেখা গেলো, দারুল উলুম ফুলতলী মাদরাসার মাঠে প্রায় শ’খানেক লোক জড়ো হয়ে গেছে। সবার হাতেই কাস্তে-দড়ি। ছাত্রদের জন্য দেড়শো কাস্তে আলাদা করে আনা হয়েছে। আর এ শ’খানেক লোক এসেছে স্ব-উদ্যোগে। ফুলতলী বিলে তাদেরও ক্ষেত আছে, আজকে তারা অন্যের ধান কেটে দিবে, পরদিন অন্যরা কেটে দিবে তাদের ক্ষেতের ধান। ফুলতলীর ছোট ছোট ছেলেরাও চলে এসেছে দড়ি-দাড়া নিয়ে। তারা মাদরাসার ছাত্রদের সঙ্গে করে ক্ষেত থেকে ধান আনবে। মকতবের বাচ্চা মেয়েরাও এসেছে, তাদের কোনো কাজে লাগানো যায় কি-না !

একটু পর মসজিদ থেকে বেরিয়ে এলেন আজগর মহাজন, মুফতি সাহেবসহ মাদরাসার বাকি শিক্ষকরা। মাদরাসার ছাত্রদের রাতেই বলে দেয়া হয়েছিলো কাকে কোন কাজ করতে হবে। নামাজ শেষ করেই তারা লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে বেরিয়ে এলো। আজগর মহাজন সবাইকে নিয়ে বিলের দিকে রওনা হলেন।

ফুলতলী বিলের পশ্চিম পাশের ক্ষেতগুলো থেকে ধান কাটা শুরু করলো স্বেচ্ছাসেবকরা। ক্ষেত অনুযায়ী একেক ক্ষেতে দশ থেকে বিশজন করে স্বেচ্ছাসেবককে কাজে লাগিয়ে দেয়া হলো। প্রতি ক্ষেতে মাদরাসার ছাত্রদের সঙ্গে কয়েকজন করে অভিজ্ঞ লোককে দেয়া হলো। তারা ধান কাটা, আঁটি বাঁধা, বোঝা বাঁধার বিদ্যা ঝালাই করে দিচ্ছিলো ছাত্রদের। ধান কাটুরে ছাত্ররা ধান কেটে আঁটি বেঁধে সেগুলো ছোট ছাত্রদের মাথায় তুলে দিচ্ছিলো আর বলে দিচ্ছিলো- এটা কার ক্ষেতের ধান।

মাদরাসার মাঠের দক্ষিণ পাশে পুকুর, পুকুরের দক্ষিণ পাশে বিশাল জায়গা খালি পড়ে আছে। সেখানে ধান মাড়াইয়ের চারটে মেশিন বসানো হয়েছে। মাদরাসার ছাত্র আর এলাকার ছেলেপেলেরা ধানের বোঝা এনে সেখানে রাখছে। প্রতি ক্ষেতের ধান আলাদা আলাদা করে রাখা হচ্ছে।
যুবক স্বেচ্ছাসেবক, যাদের ধান মাড়াইয়ের অভিজ্ঞতা আছে, এমন প্রায় পনেরো-বিশজন চারটে মেশিনে মাড়াই শুরু করে দিয়েছে। যে কৃষকের ক্ষেতের ধান ছাত্ররা মাথায় করে এনে রাখছে, সে সেখানে উপস্থিত থেকে যুবক স্বেচ্ছাসেবকদের দিয়ে ধান মাড়াই করিয়ে নিচ্ছে। ধান মাড়াই শেষ হলে কৃষক বস্তায় ভরে ধান ভ্যানে তুলে দিচ্ছে, ভ্যানচালক ধান নিয়ে ফেলছে কৃষকের বাড়িতে। বাড়িতে মেয়েছেলেরা তৈরি হয়ে আছে। ধানের বস্তা বাড়িতে আসতেই সেগুলো দুয়ারে নিয়ে স্তূপ করে রাখছে কিংবা আঙিনায় ছড়িয়ে দিচ্ছে রোদে। খালি বস্তাগুলো আবার পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে ধান মাড়াইয়ের খোলা’য়। আবার শুরু হচ্ছে আরেক কৃষকের ধান মাড়াইয়ের কাজ।

মসজিদের মুআজ্জিন চান মিয়া মুন্সি ওদিকে আরেক কাজ করে ফেললেন। তিনি আট-দশজন লোক নিয়ে গ্রামের প্রতি বাড়ি থেকে চাল-ডাল, তরি-তরকারি আর রান্নার বাদবাকি অনুষঙ্গ চেয়ে আনলেন। মাদরাসার মাঠের একপাশে মাটি খুঁড়ে ইয়া বড় চুলা বানিয়ে ফেললেন কয়েকজনকে নিয়ে। গ্রামের সমিতির বড় বড় চারটে ডেগ এনে তাতে বসিয়ে দিলেন। রান্নার পেয়াজ-মরিচ আর সবজি কাটাকুটি চলতে লাগলো। সকালে মাদরাসার ছাত্র আর স্বেচ্ছাসেবকদের খাবারের আয়োজন হবে সবজি-খিচুড়ি।

নাস্তার বেলা হতে হতে সারা গ্রামে উৎসবমুখর পরিবেশ ভরে উঠলো। বাড়িতে বাড়িতে চর্চা চলছে- মাদরাসার ছাত্ররা ধান কেটে দিচ্ছে ফুলতলী বিলের। আশপাশের গ্রামের লোকেরা এ খবর পাওয়ার পর চলে এসেছে পশ্চিম পাশের রাস্তার ধারে। সেখানে দাঁড়িয়ে তারা ছাত্র আর স্বেচ্ছাসেবকদের ধান কাটার উৎসব দেখছে।
সকালের খিচুড়ি রান্না হতেই সেগুলো ভ্যানে করে পাঠিয়ে দেয়া হলো পশ্চিম বিলে। কাজ রেখে ক্ষেতের পাশে গাছের ছায়ায় বসেই খেয়ে নিলো সবাই। দুপুরের খাবারও ক্ষেতেই পাঠানো হবে। এরই মধ্যে দুপুরের খাওয়ার আয়োজন শুরু হয়ে গেছে-  পায়জাম চালের ভাতের সঙ্গে মুরগির ঝোল আর খেসারির ডাল।
***
দুপুরের খানিক পর স্থানীয় ‘দৈনিক দেশকাল’ পত্রিকার এক প্রতিবেদক এসে হাজির হলেন মাদরাসার সামনে। তিনি ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ‘প্রথম উষার’ও স্থানীয় প্রতিনিধি। এ স্বেচ্ছাশ্রমের খবর শুনে চলে এসেছেন প্রতিবেদন তৈরি করতে। মাদরাসার সামনে চান মিয়া মুন্সি রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলেন, তিনি সাংবাদিককে মাদরাসার মুহতামিম সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে বললেন।

মুফতি আবদুল হাকিম ফারুকীর সঙ্গে এটা সেটা নিয়ে কথা বলতে বলতে সাংবাদিক জানতে চাইলেন, এ কাজের উদ্যোক্তা কে?
মুফতি সাহেব বললেন, আসলে উদ্যোক্তা কেউই নয়। আমার স্ত্রী আমাকে এমন কিছু একটা করার জন্য বলেছিলো, সেটাই আমি কমিটিকে বলি। তারা উদ্যোগটা ভালো মনে করে সকলে মিলেমিশে কাজটা করে নিচ্ছি। একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করলে সেখানে আল্লাহ সাহায্য করেন। তিনি কুরআনে বলেছেন-  ‘তোমরা আল্লাহর রশিকে সকলে মিলে শক্ত করে ধরো, পৃথক হয়ো না।’

সাত
‘এক নারীর উদ্যোগে হেসে উঠলো ফুলতলী’
পরদিন সকালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক ‘ঊষার আলো’ পত্রিকার শেষপাতার দুই কলামের শিরোনামটা দেখে চমকে উঠলেন থানার দারোগা কাসেম ভূইঁয়া। ফুলতলীতে এমন একটা কাজ হচ্ছে অথচ তিনি জানেন না! আরেকটু ধাতস্থ হয়ে পুরো সংবাদটি মনোযোগ দিয়ে পড়লেন।

একটু পরই পৌরসভার চেয়ারম্যান, উপজেলার টিএনও, কৃষি অফিসার, শিক্ষা অফিসারকে নিয়ে দারোগা কাসেম ভূইঁয়া তিনটি গাড়ি নিয়ে ফুলতলী এলেন। জলিল চেয়ারম্যান আর আজগর মহাজন আগেই খবর পেয়েছিলেন। থানার দায়িত্বশীল অফিসারদের আসতে দেখে তাদের সম্ভাষণ জানিয়ে মাদরাসার দপ্তরে নিয়ে বসালেন।

আজগর মহাজন অতিথিদের জানালেন, আজকের মধ্যে না হলেও কালকে দুপুরের আগেই পুরো বিলের ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে। মাদরাসাছাত্রদের কাজের উৎসাহ দেখে আশপাশের গ্রামের লোকজনও আগ্রহী হয়ে ধান কাটায় লেগে গেছে।
কৃষি অফিসার বয়সে তরুণ, তিনি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ধান কাটা উৎসব দেখতে এসেছি। এখানে বসে না থেকে আমাদের মনে হয় বিলে যাওয়া উচিত।

উপজেলা টিএনও সাহেবও তাই বললেন, হ্যাঁ, চলেন। একদম সরেজমিনে প্রতিবেদন যাকে বলে।
পৌরসভার চেয়ারম্যান রাশভারি মানুষ। তিনি মুফতি সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, হুজুর, আপনার ওয়াইফ তো বিরাট বিদ্বান মানুষ। আমার সালাম দিয়েন তাকে।
আজগর মহাজন খবরের কাগজের কাহিনি জানেন না। তিনি চমকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হুজুরের ওয়াইফ আবার কী করলো?
: আরে মহাজন সাব, আপনি আজকের উষার আলো পড়েন নাই? এই দেখেন…। এ কথা বলেই কৃষি অফিসার সঙ্গে আনা উষার আলো পত্রিকাটা সবার সামনে মেলে ধরেন- ‘…স্থানীয় মাদরাসার পরিচালক মুফতি আবদুল হাকিম ফারুকী জানান, তার স্ত্রী দু’দিন আগে মাদরাসার ছাত্রদের সহযোগিতায় গ্রামের ধান কেটে তুলবার পরামর্শ দেন। সেই পরামর্শ মতোই মাদরাসা কমিটি গ্রামবাসীকে নিয়ে এ উদ্যোগ গ্রহণ করে। … ’
খবর পড়ে জলিল চেয়ারম্যান বাহবা দিয়ে উঠেন, ঘটনা কি সত্যি নাকি হুজুর?
মুফতি আবদুল হাকিম ফারুকী দারুণ বিব্রত হয়ে পড়েন। সাংবাদিকের কাছে কথাচ্ছলে বলা তথ্যটা যে এভাবে ফলাও করে প্রকাশ করা হবে, এটা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। কোনোরকম মাথা নিচু করে জবাব দেন, জি, সে-ই বলছিলো কথাটা।
আজগর মহাজন সোৎসাহে বলে উঠেন, আলহামদুলিল্লাহ! এমন ওয়াইফ ঘরে ঘরে পয়দা হোক।
একটু পর বিলে ধান কাটা দেখতে আসেন থানার অফিসাররাসহ এলাকার গণ্যমান্য লোকজন। আজগর মহাজন সবাইকে নিয়ে ধানকাটুরেদের কাছে চলে যান।

প্রায় আড়াইশো লোকের একসঙ্গে ধান কাটার এ স্বেচ্ছাশ্রমের মহাযজ্ঞ দেখে আনন্দে উদ্বেলিত হন সবাই। পৌরসভার চেয়ারম্যান ঘোষণা দেন- আজকের দুপুরের খাবার তিনি মাদরাসার ছাত্রদের সঙ্গে খাবেন। তার সঙ্গে আসা দুজন স্থানীয় নেতাকে বললেন গ্রাম থেকে একটা গরু কিনে রান্নার ব্যবস্থা করতে। অন্য অফিসাররাও জানালেন- আজকে দুপুরে না খেয়ে তারা ফুলতলী থেকে কোথাও যাচ্ছেন না। এমন একটা মহৎ উদ্যোগের উদ্যোগী লোকজনের সঙ্গে একসঙ্গে খেতে পারা পরম সৌভাগ্যের বিষয়।

পরিশিষ্ট
রাতের বেলা। ঘরের বারান্দায় পাটি পেতে বসে আছেন মুফতি আবদুল হাকিম ফারুকী ও আয়েশা। বিদ্যুৎ নেই, বারান্দায় চাঁদের আলো এসে পড়ছে। ঝিরঝির দখিনা বাতাস বইছে। বাড়ির চারপাশের টিনের বেড়া থাকা সত্ত্বেও কিছু বাতাস উড়নচণ্ডি  হয়ে দোলা দিয়ে যায় বারান্দায়।
কথা বলে ওঠে আয়েশা, মুফতি সাব হুজুর!
: হুমম।
: আমারে একটা চাঁদ কিনা দিবেন?
: চাঁদ কি কেনার জিনিস?
: না, বলেন আপনি কিনা দিবেন কি-না?
: আমি এতো বড় চাঁদ কিনবো ক্যামনে ? গরিব মানুষআমি !
: তাইলে আমি যদি একটা চাঁদ কিনা দেই আপনেরে , আপনে নিবেন?
মুফতি আবদুল হাকিম ফারুকী হাসি হাসি মুখ করে তাকায় চাঁদমুখ আয়েশার দিকে। আয়েশার মুখটা কেমন অচেনা মনে হয় চাঁদের আলোতে।
মুফতি সাবকে চুপ করে থাকতে দেখে আয়েশা আবার বলে উঠে- বলেন নিবেন কি-না?

: আচ্ছা নিবো, যাও।
: ধরেন, আপনারে একটা আস্ত চাঁদ দিলাম…। বলেই মুফতি সাবের হাতটা নিয়ে নিজের পেটের উপর রাখে আয়েশা।
মুফতি সাহেব চমকে তাকান আয়েশার দিকে- মানে?
আয়েশা মুফতি সাহেবের কাছাকাছি এসে কানে কানে বলে- আমি পেটের মধ্যে আপনার জন্য একটা চাঁদ পুষতেছি। চাঁদটা বড় হলে আপনারে দিবো। আমার পক্ষ থেকে এইটা আপনার জন্য উপহার।

মুফতি সাহেব হতভম্ব হয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। আয়েশার হেঁয়ালি কথার অর্থ বুঝতে তার কিছুটা সময় লাগে। যখন বুঝতে পারেন তখন তাকিয়ে দেখেন আয়েশার চোখভরা জল। চাঁদের আলোয় চিকচিক করে করছে অজস্র  অশ্রুবিন্দু। মুফতি সাহেব গভীর মমতায় নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন আয়েশাকে।

মুফতি সাবের ছোট্ট ঘরের বারান্দায় কয়েক টুকরো চাঁদ যেন গলে গলে মিশে যাচ্ছে বিভাবরী চন্দ্রিমা জ্যোৎস্নায়।

প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

আরো পড়ুন পোস্ট করেছেন

Comments

লোড হচ্ছে...
শেয়ার হয়েছে