এই প্রবন্ধটি শ্রদ্ধেয় মুফতী তক্বী উসমানী সাহেবের বই- ”ইসলামের দৃষ্টিতে সুদ ও তার প্রতিকার” থেকে নেওয়া।
“দিরহাম ও দিনারের (অর্থের) আবিস্কার আল্লাহর অসংখ্য নেয়ামতের একটি। …. এগুলো হচ্ছে এমন পাথর যার নিজস্ব কোন ব্যবহার বা উপযোগ নেই। কিন্তু সকল মানুষেরই এগুলোর প্রয়োজন পড়ে। প্রত্যেক মানুষেরই তার খাওয়া, পড়া ইত্যাদি প্রয়োজন পূরণের জন্যে বহু রকমের পণ্যসামগ্রীর দরকার হয়। কিন্তু কখনও কখনও এমন হয় যে, যে জিনিস তার দরকার তা তার নেই; আবার যা তার আছে তাতে তার প্রয়োজন পূরণ হয় না। এ অবস্থা পণ্যসামগ্রীর বিনিময়কে অত্যাবশ্যকীয় করে তোলে। আর এ জন্যে এমন একটি পরিমাপক প্রয়োজন যার দ্বারা পণ্যসামগ্রীর দাম নিরূপণ করা সম্ভব হয়। কারণ বিনিময়ের পণ্যদ্রব্যের জাত, গুণ ও মান এক রূপ নয়; আর ওজন, পরিমাণ ও গণনার দিক থেকেও এসবের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য বিদ্যমান। কোন একটি পণ্যের কত পরিমাণ অন্য আরেকটি পণ্যের ন্যায্য দাম হবে তা নিরূপণ করা অসম্ভব। সুতরাং এসব পণ্যের মধ্যে এমন একটি মধ্যস্থতাকারী দরকার যা সুবিচারের ভিত্তিতে প্রতিটি পণ্য সামগ্রী ও সেবার দাম নিরূপণ করতে পারে।.. সুতরাং সর্বশক্তিমান আল্লাহ সকল সামগ্রীর মধ্যে বিচারক ও মধ্যস্থতাকরাী হিসাবে দিরহাম ও দিনার (অর্থ) সৃষ্টি করেছেন যাতে এর দ্বারা সকল প্রকার সম্পদের মূল্য পরিমাপ করা যায়। … অর্থ মূল্যের পরিমাপক; কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, অর্থ নিজেই একটি পণ্য। অর্থ নিজে একটি পণ্য হলে অবস্থা এই হতো যে, কোন ব্যক্তি যখনই মনে করত যে, বিশেষ উদ্দেশ্যে তার অর্থ ধরে রাখা দরকার, তখন সে এর উপর বেশী গুরুত্বারোপ করত। অপরদিকে যার অনুরূপ কোন উদ্দেশ্য নেই, সে এর ওপর এমন গুরুত্ব দিত না; ফলে সমগ্র ব্যবস্থাপনা বিপর্যস্ত হয়ে পড়তো। আল্লাহ এজন্যে অর্থ সৃষ্টি করেছেন, যাতে তা এক হাত হতে অন্য হাতে আবর্তিত হয় এবং ন্যায়সংগতভাবে পণ্যসামগ্রীর মূল্য পরিমাপক হিসেবে কাজ করতে পারে ও অর্থের বিনিময়ে অন্যান্য সকল পণ্য ও সেবা পাওয়া সম্ভব হয়। অর্থের কাজকে সামনে রেখে বলা যায়, যার কাছে অর্থ আছে, তার কাছে যেন যাবতীয় পণ্যসামগ্রীই রয়েছে। কিন্তু কারো কাছে অর্থ না থেকে যদি কোন পণ্য, যেমন, কেবল কাপড় থাকে তাহলে এ কথা বলা যাবে না। কারণ যার কাছে কাপড় আছে, সে কেবল কাপড়েরই মালিক; তার যদি খাদ্যের প্রয়োজন হয়, আর খাদ্যের মালিক যদি কাপড়েরর পরিবর্তে তার খাদ্য বিনিময় করতে রাজি না হয়; কারণ উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক, খাদ্যের মালিকের কাপড়ের দরকার নেই, তার দরকার একটি পশু। সুতরায় এমন একটি জিনিস দরকার যা বাহ্যত কিছুই না; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেটিই সব কিছু। এটি এমন জিনিস যার কোন বিশেষ রূপ নেই; কিন্তু বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর সঙ্গে বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করতে সক্ষম। এটি আয়নার মতো। আয়নার নিজস্ব কোন রং নেই; কিন্তু আয়না নিজের মধ্যে সকল রংয়ের প্রতিফলন ঘটাতে পারে। অর্থের ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য। অর্থ নিজেই কোন উদ্দেশ্য নয়; বরং সকল উদ্দেশ্য সাধনের একটি হাতিয়ার বা বাহন মাত্র।
সুতরাং যে কেউ অর্থ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্যের বিপরীত পন্থায় অর্থকে ব্যবহার করে, সে আসলে আল্লাহর নেয়ামতেরই অমর্যদা করে। যে অর্থ মজুদ করে, সে প্রকৃতপক্ষে এর প্রতি অবিচার করে এবং অর্থের মূল উদ্দেশ্যকে ব্যহৃত করে। তার অবস্থা সেই ব্যক্তির মত যে তার শাসককে কারারুদ্ধ করে রাখে…।
আর সে অর্থকে সুদী কারবারে খাটায়, প্রকৃতপক্ষে সে আল্লাহর নেয়ামতকে অস্বীকার করে এবং অবিশ্বাস করে; কারণ উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার হিসেবে অর্থের জন্ম; কেবল অর্থের জন্যেই সৃষ্টি হয়নি। অর্থকে যারা বাণিজ্যিক পণ্য বানিয়েছে এবং খোদ অর্থের কারবারে লিপ্ত হয়েছে, তারা প্রকারান্তরে অর্থকে এমন একটি পণ্যে রূপান্তর করেছে যা অর্থ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থি। আর যে উদ্দেশ্যে অর্থের জন্ম, তার বিপরীত উদ্দেশ্যে এর ব্যবহারই হচ্ছে প্রকৃত জুলুম বা বেইনসাফী। কাউকে খোদ অর্থের কারবার করতে দেওয়া হলে, অর্থই তা চূড়ান্ত লক্ষ্যে পরিণত হবে এবং মওজুদ অর্থের মতো অর্থ তার কাছে বন্দি হয়ে পড়বে। কোন শাসককে কারারুদ্ধ করে রাখা অথবা কোন ডাকপিয়নকে মানুষের কাছে চিটিপত্র পৌঁছানো থেকে বিরত রাখা বেইনসাফী বা জুলুম ছাড়া আর কি হতে পারে। 70
141. অর্থের প্রকৃতি সম্পর্কে ইমাম গাযালী রহ. এই সংক্ষিপ্ত অথচ পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ করেছেন 900 বছর আগে। এর শত শত বছর পরে যে সকল অর্থনীতিবিদ দুনিয়াতে এসেছেন তারা প্রায় সকলেই গাযালীর ওই ব্যাখ্যাকে যথার্থ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। অর্থ হচ্ছে বিনিময়ের একটি মাধ্যম ও দাম পরিমাপের হাতিয়ার। একথা প্রায় সকল অর্থনীতিবিদের নিকট সাধারণভাবে স্বীকৃত। অর্থের এই কাজকে স্বীকার করে নেয়ার পর স্বাভাবিক যুক্তিতে একথা আসে যে, এরপর অর্থকে বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। কিন্তু ইমাম গাযালী এই কথা যেরূপ পরিস্কারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, পরবর্তী অর্থনীতিবিদদের অধিকাংশই তা যথার্থভাবে উপলদ্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন; বরং আধুনিক অর্থনীতিবাদগণ অর্থকে অন্যান্য পণ্যের মত একটি পণ্য হিসেবে ধরে নিয়েছেন। আর এ কারণে তাঁরা এমন এক উভয় সংকটময় অবস্থার সৃষ্টি করেছেন যার সন্তোষজনক কোন সমাধান দেওয়া কখনও সম্ভব হয়নি।
অর্থনীতিতে সকল পণ্যসামগ্রীকে দু’ভাবে ভাগ করা হয়েছে। একশ্রেণীর পণ্যসামগ্রী হচ্ছে প্রাথমিক পর্যায়ের, যেগুলোকে সাধারণত ভোগ্য পণ্য বলা হয়। আর দ্বিতীয় শ্রেণীর পণ্য হচ্ছে উচ্চতর পর্যায়ের, যাকে বলা হয় উৎপাদনশীল পণ্য (Productive Goods)। যেহেতু অর্থের নিজস্ব কোন উপযোগ নেই, তাই অর্থকে ভোগ্য পণ্যের (Consumption Goods) অন্তর্ভুক্ত করা যায় না; আবার যেহেতু উৎপাদনশীল পণ্য ছাড়া আর কোন বিকল্পও নেই, তাই অধিকাংশ অর্থনীতিবিদই অর্থকে উৎপাদনশীল পণ্য গণ্য করেছেন। কিন্তু ন্যায়সংগত যুক্তির দ্বারা একথা প্রমাণ করা যায় নি যে, অর্থ মূলধণের একটি উৎপাদনশীল সামগ্রী। লুডউইগ ভন মাইসেস বর্তমান শতকের একজন সুপরিচিত অর্থনীতিবিদ। তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন-
“অর্থনৈতিক পণ্যে এই দুটি ভাগকে যদি আমরা চুড়ান্ত বিভাজন বলে মেনে নিই, তাহলে অর্থকে এর কোন না কোন ভাগের অন্তর্ভুক্ত করতেই হবে। আর অধিকাংশ অর্থনীতিবিদদের অবস্থা এটাই। যেহেতু অর্থকে ভোগ্য পণ্যের শ্রেণীভুক্ত করা একবারেই অসম্ভব, সেহেতু একে উৎপাদনশীল পণ্যের অর্ন্তভুক্ত না করে কোন উপায় নেই।” 71
142- এ মতের পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি পেশ করার পর তিনি যে মন্তব্য করেনে তা হচ্ছে- একথা সত্য যে, অধিকাংশ অর্থনীতিবিদই অর্থকে উৎপাদনশীণ পণ্য ধরে নিয়েছেন; কিন্তু এ ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য বক্তিগন যে যুক্তি দিয়েছেন তা অসিদ্ধ। যে কোন তত্ত্বে যথার্থতা প্রমাণিত হয় যুক্তি দ্বারা; উদ্ভাবক বা পেশকারীর নাম দ্বারা নয়।
এসব বিশেষজ্ঞদের প্রতি পূর্ণ সম্মান প্রদর্শন করে বলা যায় যে, এ ব্যাপারে সামগ্রিকভাবে তারা তাদের অবস্থঅনের পক্ষে যৌক্তিকতা প্রতিবাধন করতে পারেননি।
143. উপরোক্ত মন্তব্য করার পর ভন মাইসেস উপসংহার টেনে বলেছেন: এই দিক থেকে বিচার করলে অর্থ হিসেবে ব্যবহৃত জিনিস হচ্ছে তাই, যাকে এ্যডাম স্মিথ যথার্থ “মৃত মওজুদ” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, যা কিছুই উৎপাদন করে না।
144. অতঃপর লেখক কীনসের তত্ত্বের প্রতি তার সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। এ তত্ত্বে বলা হয়েছে যে, অর্থ যেমন একটি ভোগ্যপণ্য নয়, তেমনি তা উৎপাদনশীল পণ্যও হতে পারে না; বরং অর্থ হচ্ছে বিনিময়ের একটি মাধ্য মাত্র। 73
70 এ হচ্ছে ইমাম গাযালী কর্তৃক বিস্তারিত আলোচনার সংক্ষিপ্ত অনুবাদ; তিনি তাঁর যুগান্তকারী সৃষ্টি ইয়াহইয়াউ উলুমূমিদ্দীন গন্থে (কায়রো 1939) 4র্থ খন্ডের 88-89 পৃষ্ঠায় এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। এতে তিনি এটাও দেখিয়েছেন যে, অর্থের কারবার নিষিদ্ধ হওয়ার বিধান এক জাতের মুদ্রার (একই দেশের) সমমানের এককের বিনিময় কালে প্রযোজ্য। পক্ষান্তরে ভিন্ন ভিন্ন দেশের মুদ্রার পারস্পরিক বিনিময়কে তিনি বৈধ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি এ উভয় ধরণের বিনিময়ের পার্থক্য ব্যাখ্যা করেছেন।
71- লুডউইগ ভন মাসেস: দি থিওরি অব মানি এন্ড ক্রেডিট, লিবার্টি ক্লাসিক ইন্ডিয়ানা পোলিস, 1980, পৃ- 95।
73- দি রিপোর্ট অব দি ইকোনোমিক ক্রাইসিস কমিটি, সাইদাম্পটন চেম্বার অব কর্মাস, 1933, পার্ট- 3, (3) প্যারা-2। মি. পিএম পিওকক (ডাইরেক্টর, ইন্সটিটিউট অব রেশন্যাল ইকোনমিক্স) কে ধন্যবাদ। তিনি অনুগ্রহ করে ওই রিপোর্টের একটি কপি আমাদের দিয়েছেন।
চলবে…
Comments