সুদ নিষিদ্ধ করার মৌলিক কারণ। পর্ব- ৩

মূল: মুফতী তক্বী উসমানী সাহেব।
অনুলিপি: মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম।
এই প্রবন্ধটি শ্রদ্ধেয় মুফতী তক্বী উসমানী সাহেবের বই- ”ইসলামের দৃষ্টিতে সুদ ও তার প্রতিকার” থেকে নেওয়া।
145. অর্থের প্রকৃতি সম্পর্কে উপরোক্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পর এর যুক্তিসংগত পরিণতি এটা হওয়াই উচিত ছিল যে, অর্থকে এমন একটি হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করা হবে না, যা দৈনিক ভিত্তিতে অধিক থেকে অধিকতর অর্থের জন্ম দিতে পারে; অথবা অর্থকে একটি বাণিজ্যিক পণ্য বানানো হবে না, যাতে একই জাতের একই মূল্যমানের মুদ্রার বিনিময় হয়। অর্থ ভোগ্য পণ্য নয়, আবার উৎপাদনশীল পণ্যও নয়; বরং অর্থ বিনিময়ের একটি মাধ্যম মাত্র। একথা মেনে নেয়ার পর অর্থকে লাভজনক ব্যবসায়িক পণ্য বানানোর আর কোন সুযোগ থাকে না। এর পরও যদি তা করা হয়, তাহলে খোদ মধ্যস্থতাকারীকেই পক্ষ বানানো হবে। কিন্তু সম্ভবত সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থার অতি ব্যাপকতা ও প্রাধান্যের কারণে অর্থনীতিবিদদের অনেকেই এ দিকে আর অগ্রসর হননি।
146. কিন্তু ইমাম গাযালী অর্থ বিনিময়ের মাধ্যম-এ ধারণা বা মতবাদকে গ্রহণ করেছেন এবং একে যৌক্তিক পরিণতিতে পৌঁছে দিয়েছেন। উপসংহার টেনে তিনি বলেছেন, একই জাতের মুদ্রা বিনিময়কালে এরূপ বিনিময়কে মুনাফা অর্জনের হাতিয়ার বানানো যাবে না।
147. ইমাম গাযালীর এই অভিমত পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট নির্দেশনার ওপর ভিত্তিশীল। বাস্তববাদী কতিপয় স্কলারও একথা সত্য বলে স্বীকার করেছেন। এমনকি, সুদের প্রাধান্য আছে এমন সমাজের কিছু স্কলারও এ সত্য মেনে নিয়েছেন। এ সব স্কলারদের অনেকেই অর্থের কারবারকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা তাদের আর্থিক পদ্ধতির নিদারূণ পরিণতি প্রত্যক্ষ করেছেন। তারা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে, অর্থের প্রধান কাজ হচ্ছে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কাজ করা; অর্থের কাজকে এর মধ্যে সীমিত না রাখাই হচ্ছে তাদের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের প্রধান কারণ (অন্যান্য কারণের সাথে)
148. 1930 এর দশকে ভয়াবহ মন্দা চলছিল; এই বিপর্যয়কর অবস্থায় 1933 সালের জানুয়ারি মাসে সাউদাম্পটন চেম্বার অব কর্মাস কর্তৃক “ইকোনমিক ক্রাইসিস কমিটি” নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটিতে মি. ই. ডেনিস মান্ডির নেতৃত্বে 100 জন সদস্য ছিলেন। কমিটি তাদের প্রতিবেদনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সৃষ্ট বিপর্যয়কর ও মন্দার মূল কালন সম্পর্কে আলোচনা করেছে এবং সংকট উত্তরণের জন্যে বিভিন্ন পরামর্শ পেশ করেছে। প্রচলিত অর্থব্যবস্থার ক্রুটি তুলে ধরে এর প্রতিবিধানকল্পে কমিটি যেসব সুপারিশ করেছে তার মধ্যে একটি সুপারিশ ছিল-
“অর্থ যাতে বিনিময় ও বন্টনের মাধ্যমে হিসেবে সত্যিকার অর্থে এ যথার্থ কাজ করতে পারে সেজন্যে পণ্য হিসেবে অর্থের কারবার বন্ধ করা বাঞ্ছনীয়।74
149. এটাই হচ্ছে অর্থের সত্যিকার কাজ ও প্রকৃতি। একে অর্থব্যবস্থার মৌলিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করাই ছিল যথার্থ। কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ নীতিকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। তবে আধুনিক অর্থনীতিবিদগণ বর্তমানে ক্রমবর্ধমানহারে এ সত্য উপলদ্ধি করেছেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন গ্রে ফলস ডাউন (অলীক প্রভাত) নামে তাঁর সাম্প্রতিক গবেষণা গ্রন্থে নিম্নরূপ মন্তব্য করেছেন:
“এটা অতি তাৎপর্যপূর্ণ যে, সম্ভবত বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে লেনদেন আশ্চর্যজনক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। দৈনিক প্রায় 1.2 ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমমূল্যের অর্থ বিনিময় হচ্ছে যা বিশ্ব বাণিজ্যের পঞ্চাশ গুণেরও অধিক। এ লেনদেনের শতকরা 95 ভাগই হচ্ছে ফটকামূলক; এতে অনেকেই ‘ফিউচারস’ ও ‘অপশন’র ভিত্তিতে উদ্ভাবিত জটিল ও নতুন আর্থিক ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করছে। মাইকেল এলবার্টের মতে বিশ্বের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ হচ্ছে প্রায় 900 বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান, যা ফ্রান্সের বার্ষিক মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) সমান এবং বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকসমূহের সংরক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের চেয়ে প্রায় 200 মিলিয়ন মার্কিন ডলার বেশী।
এই অপ্রকৃত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার (ভার্চুয়াল ইকোনমি) এক ভয়ংকর ক্ষমতা রয়েছে, যা মৌলিক ও প্রকৃত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে লন্ডভন্ড ও বিপর্যস্ত করে দিতে পারে। 1990 সালে বৃটেনের প্রাচীনতম ব্যাংক ব্যারিংস-েএর পতনে এটাই দেখা গেছে।” 75
জন গ্রে এসব উদ্ভুত অর্থের আকার ও পরিমাণ সম্পর্কে প্রসঙ্গক্রমে যা উল্লেখ করেছেন, তা হচ্ছে উদ্ভুত অর্থের দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ। তবে উদ্ভুত অর্থের মোট পরিমাণ বা মূল্য তার চেয়ে অনেক বেশী। রিচার্ড থমসন এ সম্পর্কে তাঁর ‘এপোক্যালিপস রুলেট গ্রন্থে’ উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন- 1970 এর দশকের প্রথম দিক থেকেই উদ্ভুত আর্থিক ইন্সট্রুমেন্টের পরিমাণ বাড়তে থাকে এবং 1996 সালে তা 64 ট্রিলিযন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়, (অর্থাৎ 64,000,000,000,000)। আপনি কি ভাবতে পারেন এর পরিমাণ কত বিরাট! আপনি যদি এসব ডলার গুলোর একটির মাথায় আরেকটি বসিয়ে লম্বা করে সাজাতে থাকেন, তাহলে তা এতটা দীর্ঘ হবে যে, এখান থেকে সূর্য পর্যন্ত 66 বার পৌছাবে অথবা চন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছবে 25,900 বার।76
150. জেমস রবার্টসন তাঁর সর্বশেষ গবেষণা গন্থ ‘ট্রান্সফ্যরমিং ইকোনমিক লাইফ’ পুস্তকে এ বিষয়ে নিম্নরূপ মন্তব্য করেছেন:
“আজকের অর্থ ও অর্থব্যবস্থা অসৎ, পরিবেশগত দিক থেকে ধ্বংসাত্নক, আর অর্থনৈতিকভাবে অদক্ষ। ‘অর্থকে অবশ্যই বাড়তে হবে’, এই দৃষ্টিভঙ্গি উৎপাদনকে (এভাবে ভোগকে) প্রয়োজনীয় পরিমাণের তুলনায় বাড়িয়ে দিয়েছে। এটা অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও প্রচেষ্টার লক্ষকে ঘুরিয়ে দেয়; যার জন্যে প্রকৃত পণ্যসামগ্রী ও সেবা যোগানের পরিবর্তে অর্থ দিয়ে অর্থ লাভ করার লক্ষেই যাবতীয় প্রচেষ্ঠা পরিচালিত হয়।
…. এর পলে বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক কর্মপ্রচেষ্টাসমূহের গতি পরিবর্তিত হয়ে প্রয়োজনীয় ও উপকারী সামগ্রী ও সেবা উৎপাদন ও যোগান দেওয়ার পথ থেকে সরে যায় এবং সকল প্রচেষ্ঠা কেবল অর্থ দ্বারা অর্থ বানানোর পথে পরিচালিত হয়। পৃথিবীব্যপী প্রতিদিন যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার হস্তান্তরিত হচ্ছে তার কমপক্ষে শতকরা 95 ভাড়ই হচ্ছে কেবল অবিমিশ্র আর্থিক লেনদেন। প্রকৃত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার লেনদেনের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক ও সংযোগ নেই।77
151. ইমাম গাযালী ঠিক এই কথাই বলেছেন নয়শত বছর পূর্বে। এ ধরণের অস্বাভাবিক কারবারের মন্দ পরিণতি সম্পর্কে তিনি অন্যত্র আরও ব্যাখ্যা করেছেন নিম্নোলিখিত ভাষায়:
“রিবা (সুদ) নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ হলো, তা মানুষকে প্রকৃত অর্থনৈতিক কার্যকলাপ থেকে ফিরিয়ে রাখে। এটা এজন্যে যে, যার অর্থ আছে তাকে যখন সুদের ভিত্তিতে যে অর্থ খাটিয়ে, তাৎক্ষণিক লেনদেন বা ঋণ আদান-প্রদানের মাধ্যমে, অধিকতর অর্থ উপার্জন করতে দেওয়া হয়, তখন সে নিজেকে প্রকৃত অর্থনৈতিক কাজে নিয়োজিত করে পরিশ্রম ও কষ্ট করার চেয়ে সুদের ভিত্তিতে অর্থ বৃদ্ধি করার কৌশলকে সহজতর মরে করে। এ অবস্থা মানবতার স্বার্থ ক্ষুন্ন করে; কারণ প্রকৃত বাণিজ্যিক উৎকর্ষতা এবং শিল্প ও বিনির্মাণ ব্যতীত মানুষের প্রকৃত স্বার্থ সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়।” 78
রেফারেন্সসমূহ-
74- দি রিপোর্ট অব ইকোনমিক ক্রাইসিস কমিটি, সাইদাম্পটন চেম্বার অব কমার্স, 1933।
75- জন গ্রে, ফলস ডন দি ডিলিউশন্স অব ক্যাপিট্যালিজম, গ্র্যান্টি বুকস, লন্ডন, 1998, পৃ: 62, 1995, 24 অক্টোবরের ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল অবলম্বনে; ব্যাংক অব ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টস, বার্ষিক রিপোর্ট 1995 এবং মাইকেল এলবার্ট, ক্যাপিটালিম ওরিজিন্যাল ক্যাপিটালিজম, লন্ডন হোর পাবলিশার্স, 1993 পৃ: 188।
76- রিচার্ড থমসন: এ্যাপোক্যালিস রুলেট: দি লেথাল ওয়ার্ল্ড অব ডেরাইভেটিস, ম্যাকমিলন, লন্ডন 1998, পৃ: 4।
77- জেমস রবার্টসন, ট্রান্সফরমিং ইকোনমিক লাইফ: এ মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ, গ্রীনবুকস ডেভন, 1988।
78- গাযালী, ইয়াহইয়াউল উলম।
চলবে….

আরো পড়ুন পোস্ট করেছেন

Comments

লোড হচ্ছে...
শেয়ার হয়েছে