মওলভি আশরাফ
ঘটনার শুরু জানতে হলে, দূরবীনে চোখ রেখে, তাকাতে হবে সুদূর অতীতে; যখন- খোদদ্রোহিতার অপরাধে- সবেমাত্র পতন ঘটেছে এক জাতির। ঘটনার শুরু ঠিক তখন থেকেই…
ইহুদি জাতি! সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাকারী হিসাবে ওদের মত ধূর্ত জগতে আর নেই। এর বেশ কিছু “ঝলক” ওরা দেখিয়েছিল রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সময়েই। যদিও কয়েকবার তাঁকে হত্যার চেষ্টা ‘ওহির’ সামনে বানচাল হয়ে যায়। কিন্তু শেষমেশ খয়বরে গোশতে বিষমিশিয়ে কিঞ্চিৎ হলেও তারা সফল হয়েছিল।
ইতিহাসবেত্তারা বলে থাকেন- এই বিষের প্রভাবেই রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’শহিদ‘ হয়েছিলেন।
ঐতিহাসিকরা বলে থাকেন- খ্রিষ্টধর্মকে বিকৃতিকরণ অতঃপর ইসলাম ও মুসসলিমদের বিরুদ্ধে তাদেরকে খেপিয়ে দেওয়ার পেছনেও ছিল ইহুদিদের ভূমিকা। কিন্তু ক্রুসেডযুদ্ধে চরমভাবে খ্রিষ্টশক্তির ভরাডুবি হলে ওদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
অবশেষে ওরা গুটি চালে একেবারে অন্যভাবে। খ্রিষ্টজগতের সাথে জোট বেঁধে এমন এক পথে যুদ্ধে নামে, যে-পথে কোনো সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ূবি,কিম্বা কোনো সুলতান সুলাইমানের শক্তি নেই তলোয়ার বা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে ওদের রুখবার। এটা ছিল পৃথিবীর সবচে জঘন্য চাল।
এয়োদশ শতকের কথা। জ্ঞানবিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষে তখন ‘ইসলামী স্পেন; গোটা বিশ্বের জ্ঞান পিপাসু ছাত্রদের পথ গিয়ে একত্র হত সেখানকার শিক্ষা- প্রতিষ্ঠানগুলোতে। ঠিক এসময়ই গোড়াপত্তন ঘটে এই চক্রের। ওদের বিশাল সংখ্যক দল সেখানে পড়তে যায়। ধীরে ধীরে অর্জন করে আরবি ভাষার ওপর পান্ডিত্য। অন্যসব জ্ঞানবিজ্ঞানের পাশাপাশি ইসলাম ধর্মের ওপরও গবেষণা শুরু করে। বুৎপত্তি লাভ করে কুরআন হাদিস ও ফিকহের ওপর। তবে এতসবের উদ্দেশ্য থাকে ইসলামের সৌন্দর্য জানা নয়, বরং ইসলামের খুঁত বের করা।
এখান থেকেই শুরু ‘ইস্তিশরাকের; ইস্তিশরাক শব্দের উৎপত্তি ‘শারকুন'(شرق) থেকে। شرق মানে পূর্ব বা প্রাচ্য, আর ইস্তিশরাক অর্থ প্রাচ্য থেকে কিছু চাওয়া। পরিভাষায় ‘ইস্তিশরাক’ বলা হয়- বিকৃতিসাধন উদ্দেশ্যে পাশ্চাত্যের ইহুদি খ্রিষ্টানদের ইসলাম চর্চা কে। ইস্তিশরাক শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হল- প্রাচ্যবাদ, আর ইংরেজিতে Orientalism. আবুল হাসান আলী নদভি সাহেবের ভাষায় প্রাচ্য নিয়ে গবেষণাকারীদের উদাহরণ হল এমন- যে সাগরে ডুব দিয়েছে কিন্তু গায়ে পানি লাগেনি, অথবা একজন পরিছন্নকর্মীর মত, যে সারাদিন ফুলের বাগানে ঘোরাফেরা করেছে, কিন্তু তার চোখে ময়লা ছাড়া অন্য কিছুই খোঁজেনি।
স্পেন পতনের পর, যখন জ্ঞানবিজ্ঞানের উচ্চতর প্রতিষ্ঠানগুলো মুসলিমদের হাতছাড়া হয়ে যায়। আর এদিকে মুসলিমবিশ্ব ইহুদি খ্রিষ্টানদের ষড়যন্ত্রে ভোগবিলাসিতা আর গৃহযুদ্ধে ব্যস্ত, ঠিক এই সুযোগে ওরা মুসলিমদের কাছে থেকে নেওয়া অসংখ্য বই আর শিক্ষার জোরে, নিজেদের দেশেই তৈরি করে উচ্চতর বিদ্যাপাঠ। ধীরে ধীরে আরবি কিতাবগুলো নিজস্ব ভাষায় অনুবাদ করে, জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতে আধিপত্যের আগজোর নিজেদের হাতে তুলে নেয়। একপর্যায়ে মুসলিমদের বাধা করে ওদের শিক্ষার মুখাপেক্ষী হবে।
নেপলিয়ন বোনাপার্টের একটা উক্তি আছে- “আমাকে একজন শিক্ষিত ‘মা’ দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিবো। কথাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এজন্যই আমরা দেখতে পাই: মিশর আক্রমনের সময় তিনি শত শত পাদ্রি সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। তাদের আনবার একমাত্র ‘হেতু’ ছিল আমাদের ‘মা’দের তাদের শিক্ষায় ‘শিক্ষিত’ কার। ( এখানে ‘মা’ শব্দের অর্থ ‘গর্ভধারিনী’ না করে যদি ‘মূল’ করি, তাহলে বিষয়টি আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায়, সর্বযুগে সবদেশেই- সমাজের অধিপতিদের চেয়ে- শিক্ষিতদের প্রভাব বেশি। অধিপতিদের মান্য করে ভয়ে, কিন্তু সত্যিকারার্থে মান্য করে একমাত্র শিক্ষিতদের। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর যদি কোনো পরিবর্তন আনতেই হয়, প্রথমে পরিবর্তন আনতে হবে এই ‘মা’দের আদর্শে।
তো এ লক্ষ্যেই, যেসব মুসলিম শিক্ষার্থী জ্ঞানপিপাসায় ওদের প্রতিষ্ঠানে ছুটে যায়, ওরা তাদের সামনে উপস্থাপন করে এক ‘বিকৃত ইসলাম’। দীন সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান না রাখায় এসব শিক্ষর্থীরা তফাৎ করতে পারে না প্রকৃত আর বিকৃত ইসলামের মাঝে। ফলে অবলীলায় ওদের ষড়যন্ত্রের ‘নৌকায়’ পা দেয়। ক্রমে ক্রমে ওদের কুফরি-গ্যাস গ্রাস করে ফেলে তাদের ইমানি-অক্সিজেন। গ্রাজুয়েশন নেওয়ার পর দেখা যায়- প্রকৃত ইসলাম রয়ে গেছে কেবল তাদের পোশাকি নামে, আর ভেতরটা সম্পূর্ণ ওদের ঢুকিয়ে দেওয়া চিন্তা চেতনায় ঠাসা।
দেশে ফিরে নিজের অজান্তেই তারা ওদের প্রোপাগান্ডা বাস্তবায়ন শুরু করে। তাদের জিহ্বা তোতাপাখির মত কথা বলে ওদের হয়ে। তাদের হাত বোকা ফটোকপি মেশিনের মত ওদের চিন্তাচেতনা ছাপায়। সেসব পড়ে শুনে দেশীয় মুসলিম তরুণ তরুণীরা প্রভাবিত হয়। তারপর একসময় এরা দীন-ধর্মের ব্যাপারে সন্দেহে পড়ে যায়। গভীর বিশ্লেষণ না গিয়ে- এমনকি কখনো কখনো একদম না পড়ে- আপত্তি করতে থাকে কুরআন হাদিস ও ফিকহের বিভিন্ন প্রসঙ্গে। কেউ কেউ আবার নিজেকে ঘোষণা দিয়ে জানায়: সে খোদাদ্রোহী!
এরই নাম হলো ইস্তিশরাক!
প্রথম প্রথম প্রাচ্যবাদের ক্ষেত্রে এই “ব্রেনওয়াশের” মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ক্রমে ক্রমে সেখানে যোগ হয় আরো বেশ কয়েকটি ক্ষেত্র, যার মাধ্যমে শুধু মুসলিমদের বিপথগামী করা নয়, ওরা স্বপ্ন দেখতে থাকে এমন এক পৃথিবী শাসনের, যেখানে কোনো বিরুদ্ধ শক্তি নাই।
ইনশাআল্লাহ, আগামী পর্বে তাদের ক্ষেত্রগুলো তুলে ধরা হবে।
মওলভি আশরাফ
শিক্ষার্থী, উচ্চতর দা’ওয়াহ বিভাগ
মা’হাদ সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী
Comments