মুহিব খান
ফেব্রুয়ারি যদিও একটি ইংরেজি মাসের নাম, তবুও এটি যেন এখন একান্তই বাংলাদেশের এবং বাংলাভাষার। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা এ মাসটিকে আমাদের পরম আত্মীয় করে নিয়েছি। বিশেষ করে এ মসের ২১ তারিখটিকে বিশ্ববাসী আমাদের সম্পদ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এ দিনটিকে সবাই গ্রহণ করে নিয়েছে। এ আমাদের মহান গৌরব।
এই ভাষার একটি বিশেষ মজার দিক না লিখে পারছি না। এই ভাষায় এমন কিছু শব্দ আছে যা একবার বললে অর্থ বুঝায় বেশি। আবার দুইবার বললে অর্থ বুঝায় কম। যেমনঃ কেউ যদি বলে-‘আমার শীত করছে’ বুঝা যাবে তার পুরোপুরিই শীত করছে। আবার কেউ যদি বলে-‘আমার শীত শীত করছে’ বুঝা যাবে তার কিছু কিছু শীত করছে। তেমনি ‘আমার জ্বর’ মানে পুরোপুরিই জ্বর। আর ‘আমার জ্বর জ্বর’ মানে জ্বরের কিছুটা ভাব। তেমনি-ভয় লাগে আর ভয় ভয় লাগে, ব্যাথা লাগে আর ব্যাথা ব্যাথা লাগে। কী অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না! শুধু অদ্ভুত নয় সুন্দরও।
সেদিন এ বাংলাদেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান। আর বর্তমানের পাকিস্তানকে বলা হতো পশ্চিম পাকিস্তান। দুই পাকিস্তান মিলে ছিল একটি দেশ। সে দেশটিতে বাঙালির সংখ্যা ছিল বেশি, যারা বাংলায় কথা বলে। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু ভাষাভাষী অত্যাচারি শাসকরা বাংলাভাষাকে অপমান করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বানাতে চাইলো। সংখ্যাগরিষ্ঠের মুখের ভাষাকে অগ্রাহ্য করে সংখ্যালঘিষ্ঠের ভাষাকে জোর করে সবার উপর চাপিয়ে দেয়ার এ ষড়যন্ত্র বাঙালিরা বরদাশত করেনি। বাংলা মায়ের সন্তানরা প্রতিবাদী হয়ে উঠল এবং বিক্ষোভ-বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। শাসকরা বিরক্ত হল, ক্ষেপে গিয়ে নির্যাতন চালাল, গুলি চলল বাংলাভাষার মিছিলে। মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য ঢাকার পিচঢালা পথে রক্তাক্ত হয়ে লুটিয়ে পড়ল কয়েকটি তরুণ তাজা প্রাণ। সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার ও আরও অনেকে। ঘাতকরা পরাজয় মানতে বাধ্য হল। স্বমহিমায় উজ্জ্বল হল আমাদের প্রাণের মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষা।
বিশ্বের অনেক জাতির নিজস্ব কোন বর্ণমালা নেই। তারা নিজেদের ভাষার উচ্চারণ অন্য কোন ভাষার বর্ণের সাহায্যে লিখে থাকে। যেমনঃ উর্দু এবং ফার্সি লেখা হয় আরবী ভাষার বর্ণ ধার করে। তেমনি পশ্চিমা কিছু দেশের নিজস্ব উচ্চারণ ইংরেজি বর্ণে লেখা হয়। কিন্তু আমরা নিজেদের উচ্চারণ নিজেদের স্বতন্ত্র বর্ণমালার সাহায্যে লিখে থাকি, লিখতে পারি। এটা আমাদের সম্মানজনক বৈশিষ্ট্য। নিজের ভাষার জন্য রক্ত দিতে হয়েছ, এমন জাতি পৃথিবিতে আর নেই বললেই চলে। অনেক রক্ত- সংগ্রামের পথ পেরিয়ে অর্জিত এই এই বাংলাভাষা আজ আমাদের হাতে শহিদদের আমানত। এর সঠিক চর্চা, বিকাশ ও মর্যাদা রক্ষার দায়িত্বও আমাদের। বিশেষ করে বাংলাদেশের তারুণ্যের।
বাংলাভাষার বিশুদ্ধ উচ্চারণ, সঠিক বাচনভঙ্গি এবং নির্ভুল বানানরীতি সংরক্ষণ করা না হলে এ ভাষা আর আভিজাত্য হারাতে পারে। ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই ভাষাকে নিরাপদ রাখতে দেশিয় সংস্কৃতিকেও নিরাপদ রাখা প্রয়োজন। বিদেশি সংস্কৃতির অবাধ আধিপত্য আমাদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতিকে গ্রাস করে নিতে পারে। এ ব্যাপারে সতর্ক পদক্ষেপ না নিলে ভাষা শহীদ ও স্বাধীনতা সংগ্রামিদের সঙ্গে প্রতারণার দায় বহন করতে হবে আমাদের সবাইকে। যারা বাংলাভাষা এবং দেশিয় সংস্কৃতিকে বিকৃতরূপে চর্চা করেন বা বিদেশি ভাষা সংস্কৃতির করতলে নিজেদের ভাষা সংস্কৃতিকে বিলীন করে দেন- গায়ে পতাকার পোশাক পরে, পতাকার চিত্র এঁকে আর মাথায় পতাকার ফিতে বেঁধে- কৃত্রিম দেশপ্রেম প্রদর্শন করা তাদের উচিত নয়।
আমাদের বাংলাভাষায় কিন্তু বিদেশি শব্দের অংশগ্রহণ অনেক বেশি। বাংলাভাষার বিস্তৃত মঞ্চে অনেক অ-বাংলা শব্দকেও আমরা স্থান করে দিয়েছি। বাংলাদেশের ভাঁটি থেকে উজানে, গ্রাম থেকে শহরে আমাদের মা-চাচিরা, খালা-ফুপুরা, নানি-দাদিরা যেসব সুন্দর সুন্দর শব্দ ব্যবহার করে মনে ভাব প্রকাশ করে থাকেন-এর অধিকাংশই কিন্তু বাংলাভাষায় ‘গেস্ট ফ্রেন্ড’ বা অতিথি বন্ধু। দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকা হলে অনেক অচেনা মানুষও চিরচেনা হয়। অনেক অতিথিও হয়ে উঠে ঘরের মানুষের মতই আপনজন। ভাষার ক্ষেত্রেও তাই। যেমনঃ কাগজ, কলম, পানি, দুধ, শরবত, চা, বাজার, দোকান, ঘর, দরোজা, শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি, পায়জামা, গ্লাস, জগ, চাদর, কাপড়, সাবান, তোয়ালে, কাপ, প্লেট, ঘড়ি, চশমা, বাচ্চা, জওয়ান, ব্যাগ, বাক্স, চাল, ডাল, চেয়ার, টেবিল, রাস্তা, পথ, পাগল, দিওয়ানা, দাওয়াত, মেহমান, খানাপিনা, মুরগি, বকরি, আইন, আদালত, খুন খারাবি, বেটা, বেটি, মিয়া, বিবি, আজ, কাল, দিন, রাত, জান, মাল, ইজ্জত সবই কিন্তু আরবি, ইংরেজি, উর্দু, হিন্দি, ফার্সি, পশতুন, কিরঘিজি বা আরও অন্য কোন ভাষার বাংলা রূপায়ণ। এমন অসংখ্য শব্দ আমরা বাংলা ভাষা হিসেবেই বলে থাকি। অথচ এর কোনটিই মূলগতভাবে বাংলা নয়।
লক্ষণীয় যে, আমরা নিত্যসময় অনর্গল বলে যাই অনেক অ-বাংলা শব্দ ও বাক্য। অথচ আমরা এর বাংলা অনুবাদ জানিনা বা ভাবিনা। যেমনঃ ‘বাসের টিকেট না পেয়ে ট্রেনের সিট বুকিং করলাম। কাউন্টারে না পেয়ে ডাইরেক্ট ম্যানেজারের রুমে চলে গেলাম। উনি সিস্টেমের বাইরে স্পেশালভাবে ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট ম্যানেজ করে দিলেন। প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দেখি ট্রেন নেই। লাইনে সিগন্যাল পড়েনি। পরে ট্রেন এলেও ইঞ্জিনের ক্রাইসিস দেখা দিল, ড্রাইভার প্যাসেঞ্জার সবাই নেমে গেল। ট্রেনটি টাইম মিস করায় শিডিউল ক্যান্সেল করা হলো। কী আর করা! এতো লাগেজ নিয়ে স্টেশনে না বসে থেকে একটা ট্যাক্সি ক্যাব নিয়ে খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে রেলগেটে আমার এক ক্লোজ ফ্রেন্ডের বাসায় চলে এলাম। দরজায় নক করতেই ওর ওয়াইফ ভেতর থেকে জানালো ও বাসায় নেই। আমি পরিচয় দিয়ে দরজা খুলতে রিকুয়েস্ট করলাম। আমাকে ড্রয়িং রুমে বসতে দেওয়া হল। আমি আমার ফ্রেন্ডকে মোবাইলে কল করলাম। কয়েকবার ট্রাই করে কানেকশন পেলাম। ও লেইট না করে বাসায় চলে এলো। আমি বাথরুমে ফ্রেশ হয়ে কাপড় চেইঞ্জ করে ওর সঙ্গে লাঞ্চ সেরে আবারও রেডি হলাম এবং যথাসময়ে স্টেশনে চলে এলাম।’
আমরা যেন বাংলায় বলি, বাংলায় গাই আর বাংলায় লিখে যাই। গেঞ্জিতে আর ফতুয়ায় নয়, পাঞ্জাবি-জামা আর ওড়নায় নয় বরং অন্তরে আর চেতনায় যেন বাংলাকে দেই ঠাঁই। আর হ্যাঁ, আরেকটা কথা! ২১ ফেব্রুয়ারির পাশাপাশি আমরা যেন বাংলাভাষার বাংলা দিবস ৮ ফালগুনকে বেমালুম ভুলে না যাই। এ জাতির প্রতিটি সদস্যের প্রাণের গভীরে থাকুক বাংলা ভাষা। হিন্দি, উর্দু বা ইংরেজি নয়। ’৫২-এর অগ্নিঝরা শ্লোগান, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এর বর্তমান সংস্করণ হোক প্রাণের ভাষা বাংলা চাই।
যদি প্রশ্ন করা হয় ওপরের এ বাক্যগুলোতে বিদেশি শব্দ আছে কিনা? উত্তর হবে-‘প্রায় পুরোটাইতো ইংরেজি’। আবার যদি প্রশ্ন করা হয়-এ বাক্যগুলো বাংলা কিনা? তখনও উত্তর হতে পারে- ‘হ্যাঁ, বাংলাইতো মনে হয়’। অথচ চিহ্নিত ইংরেজি শব্দগুলো ছাড়াও পেয়ে, দেখে, চলে, না, দরজা, করে ইত্যাদি শব্দগুলোও বিদেশি শব্দ পানা, দেখনা, চালনা, নাহ, দরওয়াজা, কারনা প্রভৃতি শব্দের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। তাহলে নিরেট বাংলা শব্দ থাকল আর কী! আসলে আমাদের বাংলাভাষা বড়ই মিশুক। বড়ই বন্ধুবৎসল। বাংলাভাষা নিয়ে লিখার আছে অনেক কিছুই। এতো কিছু তো একবারে লিখা সম্ভব নয়! তবুও এই ভাষার একটি বিশেষ মজার দিক না লিখে পারছি না।
এই ভাষায় এমন কিছু শব্দ আছে যা একবার বললে অর্থ বুঝায় বেশি। আবার দুইবার বললে অর্থ বুঝায় কম। যেমনঃ কেউ যদি বলে-‘আমার শীত করছে’ বুঝা যাবে তার পুরোপুরিই শীত করছে। আবার কেউ যদি বলে-‘আমার শীত শীত করছে’ বুঝা যাবে তার কিছু কিছু শীত করছে। তেমনি ‘আমার জ্বর’ মানে পুরোপুরিই জ্বর। আর ‘আমার জ্বর জ্বর’ মানে জ্বরের কিছুটা ভাব। তেমনি-ভয় লাগে আর ভয় ভয় লাগে, ব্যাথা লাগে আর ব্যাথা ব্যাথা লাগে। কী অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না! শুধু অদ্ভুত নয় সুন্দরও।
আমাদের উচিত এই সুন্দর ভাষাটিকে যত্ন ও সম্মানের সঙ্গে ধারণ করা। আমরা আমাদের ঐতিহাসিক, সমৃদ্ধ, সুন্দর ও অমূল্য এই ভাষাকে ভালোবেসে যত্নে রাখবো-এই হোক আমাদের প্রত্যয়। আমরা ভাষা দিবসে ভাষা শহিদদের স্মরণ করি। গান গাই, ফুল নিয়ে যাই। নানা অনুষ্ঠান করি। কাঁদি এবং কাঁদাই। আর বাকিটা বছর নানাভাবে বাংলা ভাষার অবজ্ঞা ও অমর্যাদা করে যাই। শহিদদের ভুলে বসে থাকি! এটা ঠিক নয়। একদিনের কান্না ও ভালোবাসায় শহিদদের ঋণ শোধ হয় না। যে ফুল আমরা শহিদ মিনারে দেই, দিন শেষে সে ফুল পচে নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের উচিত সব সময় তাদের কথা মনে রাখা। তাদের জন্য দোয়া করা, প্রার্থনা করা। এতে তাদের সত্যিকার উপকার হবে। তারাও খুশি হবেন। আমরা যেন কৃত্রিম আনুষ্ঠানিকতার চেয়ে আন্তরিকতাকেই বেশি প্রাধান্য দেই। আমরা যেন তাদের রেখে যাওয়া ভাষাকে ভালোবেসে তাদের প্রতি ভালোবাসা দেখাই।
আমরা যেন বাংলায় বলি, বাংলায় গাই আর বাংলায় লিখে যাই। গেঞ্জিতে আর ফতুয়ায় নয়, পাঞ্জাবি-জামা আর ওড়নায় নয় বরং অন্তরে আর চেতনায় যেন বাংলাকে দেই ঠাঁই। আর হ্যাঁ, আরেকটা কথা! ২১ ফেব্রুয়ারির পাশাপাশি আমরা যেন বাংলাভাষার বাংলা দিবস ৮ ফালগুনকে বেমালুম ভুলে না যাই। এ জাতির প্রতিটি সদস্যের প্রাণের গভীরে থাকুক বাংলা ভাষা। হিন্দি, উর্দু বা ইংরেজি নয়। ’৫২-এর অগ্নিঝরা শ্লোগান, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এর বর্তমান সংস্করণ হোক প্রাণের ভাষা বাংলা চাই।
Comments