তানভীর মুহাম্মাদ
মানুষের চিন্তার জগতকে বিস্তৃত করার ক্ষেত্রে সফরের ভূমিকা অনেক। একটি সৃজনশীল সফর আমাদের জীবনবোধকে গভীর থেকে গভীর করে তোলে। আমরা পড়ে যতোটুক শিখি, তার চে হাজারগুণ বেশি শিখি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে যাত্রার মাধ্যমে আমাদের সংকীর্ণতার দুয়ার এক এক করে খুলে যায়। আজ আমি আপনাদের বলবো সফর নিয়ে আমার গল্প। গল্পটা আমার সফরের মতোই একটু অন্যরকম। সাইকেলে চেপে মাইলের পর মাইল ছুটে চলার গল্প। আমার কল্পনা, মানুষের প্রাণের উত্তাপ এবং প্রকৃতির সাথে অপূর্ব মেলবন্ধন। সব মিলিয়ে সাইক্লিং আমার জীবনের অন্যতম ঘটনা। আজ সেই গল্পই আপনাদের শোনাবো।
আকাশ দেখতে শিখেছি সেই ছোটবেলায়। আমি জানতাম না, আমি কী খুঁজতাম। শুধু দেখতাম, আকাশের কোনো সীমানা নেই। সকালের নীল আকাশ; ছুটে চলা মেঘের দল। আমার কেমন যেন ভালো লেগে যেতো। সন্ধ্যার আকাশ ছিলো আরও প্রিয়। এত্তো বিশাল আকাশটার মাঝে জ্বলজ্বলে একটা চাঁদ। আমার খুব প্রিয় ছিলো। আর রাতের আকাশ! সে তো এক অন্যরকম সৌন্দর্যে নিজেকে মেলে ধরতো। আমি দেখতাম, সেখানে তারার মেলা। পরস্পর বসে বসে গল্প করছে। মাঝে মাঝে দু’একটি তারা আমাকে চমকে দিয়ে ছুট দিতো। আমি হা হয়ে যেতাম। তারাগুলোর কি তবে প্রাণ আছে? কখনও নিজেই তারা হয়ে যেতাম। কল্পনার সেই জগতে গল্প করতাম আমার সাথী তারাগুলোর সাথে। আহা, কী সেই মুহুর্ত!
আকাশ আমার বন্ধু হলেও আমি সবুজের অভাব খুব তীব্রভাবে অনুভব করতাম। ইট-কংক্রিটের এই শহরে কতো শিশুমন আমার মতো কষ্ট পাচ্ছে, তার খবর নেবার কি কারও সময় আছে? ছোটবেলায় সমুদ্র, পাহাড়, চা-বাগান কিছুই দেখা হয় নি। আমার বেঁচে থাকার রসদ জোগাতো গ্রামের বাড়ি। বছরের দু’ঈদে আমরা সেখানে যেতাম। সেই সুযোগে আমি পেতাম নিশ্বাস নেবার একটুখানি সবুজ। মায়ায় পড়ে যেতাম। ফিরে আসতে ইচ্ছে হতো না কিছুতেই। সাতসকালে বেরিয়ে যেতাম। বন্ধু বলতে আমার ছিলো দু’তিনটে দুরন্ত বালক, অগণিত গাছ, কাঁদামাটি আর বাতাস। খুব আনন্দে বেঁচে থাকতাম দিনগুলোতে। আবার যখন ফিরে আসতাম দালান-কোঠার এ শহরে, তখন অনুভব করতাম আমি কষ্ট পাচ্ছি। ছোটবেলায় আমার পাওয়া-না পাওয়ার কষ্ট ছিলো এগুলো নিয়েই। গ্রামে সবসময় আমাকে আগন্তুক হয়ে থাকতে হয়েছে। আমাকে বেড়ে উঠতে হয়েছে অতিযান্ত্রিকতার মধ্য দিয়ে। অথচ আমি কল্পনা করতাম প্রাণবন্ত একেকটা সকাল, চঞ্চল বিকেল আর মুগ্ধ রাত!
শহুরে আমি বেড়ে উঠতে উঠতে অনুভব করলাম, আমি আকাশ আর সবুজের মায়া ছাড়তে পারছি না। সময়ের সাথে বেড়ে চলছে পড়াশোনা ও অন্যান্য চাপ। তবুও আমি অবসর পেলেই আকাশ খুঁজি; সবুজের বিরহে কষ্ট পাই। সহপাঠীরা গল্প করে। তাদের সফরের বর্ণনা দেয় রসিয়ে রসিয়ে। আমার কষ্ট বাড়েই কেবল। আমার যে কিছুই দেখা হয় নি! বড়রা আমাকে নিয়ে আশঙ্কায় পড়ে যায়। কার সাথে মিশছি, কোথায় যাচ্ছি, একাকী সময়গুলোতে কী করছি- এ নিয়ে তাদের মস্তবড় টেনশন। আমি তখন নিজেকে নিয়ে সন্দেহে পড়ে যাই। আমি কি খুব বেশি খারাপ হয়ে যাচ্ছি? আমি তো শুধু বেঁচে থাকতে চাই। শহুরে জীবনটা প্রতিমুহুর্তে আমার দম বন্ধ করে দেয়। যখন আরেকটু বড় হলাম, নিজেকে সঙ্গ দিতে শিখলাম। ইচ্ছে হলো, নিজকে একটু চিনি। একটু খুঁজে দেখি আমাকে! সুযোগ পেলে একটু বাতাস খেতে বের হতাম। কিন্তু এতে কি আর মন শান্ত হয়? আমার ভেতর তখনও অদম্য নেশা প্রকৃতিতে হারিয়ে যাবার। না জানি পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কতো অজানা সুন্দর! ভয়ঙ্কর সুন্দরের মাঝে কি কারও প্রেম বাস করে? তাহলে কে হাতছানি দিয়ে ডাকে আমায়?
একসময় আমার চিন্তা-ভাবনায় বিশাল ঝড় তোলে কুরআন। আমার সামনে একটু একটু করে উন্মেচন করতে থাকে দিগন্তবিস্তৃত অজানা রহস্য। কুরআন আমাকে বলে দেয়, এই বিশাল আকাশ, এই শান্ত-সবুজ প্রকৃতি আর ভয়ঙ্কর সুন্দরের মাঝে আমি কী খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমি অভিভূত হয়ে যাই। আমার চোখ ভিজে ওঠে। কুরআন তো সত্যিই বলছে! সেই ছোটবেলা থেকে শুধু প্রাণহীন তেলাওয়াতই করে গেলাম। বুঝতে শেখার পরও আমি আসি নি কুরআনের সান্নিধ্যে। আমি অনুতপ্ত হলাম। সেইসাথে আনন্দিতও হলাম। দেরিতে হলেও নিজেকে তো একটু একটু খুঁজে পাচ্ছি! কোথায় যেন পড়েছিলাম, ছোট্ট একটা অনুভব থেকেই শুরু হয় হাজার হাজার মাইলের পথচলা। আমার এই অনুভব থেকেই মনে হচ্ছে, আমার সামনে অপেক্ষা করছে বিশাল এক জগত। ছোটবেলা থেকে আমি যা খুঁজে বেড়াচ্ছি অস্থিরচিত্তে।
অনুভবটা আমি লাভ করি এক রাতে। আমি আবেগ নিয়ে তেলাওয়াত করছিলাম সূরা গাশিয়াহ। পড়তে পড়তে মনে হলো আমি কিছু কিছু অর্থ বুঝতে পারছি। আগ্রহ হঠাৎ বেড়ে গেলো। আমি পরিপূর্ণভাবে অর্থের দিকে মনোযোগ দিলাম। আল্লাহ বলছেন, “তারা কি আকাশের দিকে লক্ষ্য করে না, তা কীভাবে উঁচু করা হয়েছে? লক্ষ্য করে না পাহাড়ের দিকে, তা কীভাবে স্থাপন করা হয়েছে? এবং লক্ষ্য করে না পৃথিবীর দিকে, তা কীভাবে সমতল করা হয়েছে?” আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
আল্লাহ বলছেন, “তারা কি আকাশের দিকে লক্ষ্য করে না, তা কীভাবে উঁচু করা হয়েছে? লক্ষ্য করে না পাহাড়ের দিকে, তা কীভাবে স্থাপন করা হয়েছে? এবং লক্ষ্য করে না পৃথিবীর দিকে, তা কীভাবে সমতল করা হয়েছে?”
আল্লাহ কি বলতে চাচ্ছেন, এসবের মাঝে তাঁর খোঁজ পাওয়া যাবে? আমি কি তাহলে ভুল পথে নেই? সারা শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো আমার। সেই থেকে কুরআন আমার ভাবনায় এনে দিয়েছে নতুন বিপ্লব। আমাকে শিখিয়েছে, কুদরতের নিদর্শন নিয়ে ভাবো। গভীরভাবে চিন্তা করো। দেখো, এই আকাশ কতো বিশাল। তার থেকে বিশাল হতে শেখো। এই পাহাড় কীভাবে অটল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার থেকে অটল হতে শেখো। এই সবুজ কী সজীবতা নিয়ে সজ্জিত। তার থেকে সজীব হতে শেখো। চিন্তা করো আর অনুভব করো, এই বিশাল আকাশ, অটল পাহাড় ও সবুজ প্রকৃতিতে তিনি কী মায়া ঢেলে দিয়েছেন! আমার স্রষ্টা অদ্ভুত কারিগর। কী খেয়ালে তিন সৃজন করে যান, তা বোঝার সাধ্য আমায় দেন নি। রহস্যের বৈচিত্রে একটা টান ভেতর ভেতর অনুভব করি। এর কোনো ব্যাখ্যা ধরণীর বুকে নেই। আসলে এটা এমন এক ব্যাপার, যা নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবা যায় না।
একসময় আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে গেলো দ্বিচক্র। ঘটনাটা আমার জন্য আশ্চর্যজনক ছিলো। আমি কখনও ভাবি নি, স্রষ্টা আমাকে এতো সামর্থ্য দিয়েছেন। প্যাডলিং করে ঘোরাঘুরি শুরু করার পর আমার লিমিটকে চ্যালেঞ্জ করার নেশা ধরে গেলো। ছুটতে শুরু করলাম বাতাসকে সঙ্গী করে। দু’চাকার বাহনে মাইলের পর মাইল। আমার মনে হলো, আমি প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকেই দেখতে পাচ্ছি। নীরব-নিস্তব্ধ প্রকৃতির মাঝে শুরু হলো আমার প্যাডলিংয়ের মৃদু আওয়াযের কাব্য। কবি-সাহিত্যিকরা কল্পনায় কতো কিছু রচনা করে! আমাকে দিয়ে তা কখনও হয়ে ওঠে নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমি যেন বাস্তবেই কবিতায় বাস করছি!
‘ক্রিস্টোফার মোরলি’র উক্তিটা তবে যথার্থ!
The bicycle, the bicycle surely, should always be the vehicle of novelists and poets.
আমার না জানা প্রশ্নের উত্তর আমি পেয়ে গেলাম। জানতে পারলাম, কোনো একটা গন্তব্যে ছুটে যাওয়াকে ভ্রমণ বলে না। ভ্রমণ মানে গন্তব্যহীনভাবে মহাকালের সাথে যাত্রা। গন্তব্যটা থাকুক না অজানা! কোথাও তো গিয়ে নিজের দেখা পাবোই! আমি অনুভব করতে শুরু করলাম, যখন বাসে বা গাড়িতে করে একটা গন্তব্যের দিকে ছুটে যেতাম, তখন আমি হারাতাম পথের হাজারো গল্প। কিন্তু এখন? চলতে চলতে শুনতে পাই যুগের পর ছুটে চলা মানুষের কোলাহল। দেখতে পাই কালের অপ্রতিরোধ্য গতিতে হারিয়ে যাওয়া মানুষের পায়ের ছাপ। সেগুলো আমায় কতো রঙের গল্প শোনায়। পৃথিবীর পথে পথে এতো বিস্ময় ছড়ানো! আমি বিস্মিত হয়ে যাই।
Comments