বাংলা ভাষায় মুসলিম জাতির অবদান

মুহাম্মাদ রাশিদুল হক

পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাই একমাত্র ভাষা, যার স্বীকৃতির জন্য সংগ্রাম করেছে পুরো একটি জাতি। হাসিমুখে শাহাদাত বরণ করেছে অগণিত মানুষ। একমাত্র বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সংগ্রামই জন্ম দিয়েছে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। বাঙালি মুসলমানদের দুটি বড় অহঙ্কারের জায়গা রয়েছে। একটি তার দেশ, অন্যটি ভাষা। বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে মোটামুটিভাবে দশম-একাদশ শতকে। সুনীতি কুমার, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ ভাষাতাত্ত্বিক বাংলা ভাষার যে বংশাবলি নির্মাণ করেছেন তাতে দেখা গেছে, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাই বহু বছর ধরে নানা পরিবর্তন ও রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে রূপ লাভ করেছে বাংলা ভাষায়। পণ্ডিতরা প্রমাণ করেছেন বাংলা ভাষা সংকৃত ভাষার সরাসরি দুহিতা নয়।

বাংলা ভাষার নিজস্ব রূপ সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে বেশ সময় লেগেছে। পণ্ডিতদের মতে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম রূপ দেখতে পাওয়া যায়, বৌদ্ধ মরমী সাধাকদের রচিত বৌদ্ধ গান ও দোহার মধ্যে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভে বাংলা ভাষা। তবে বাংলা ভাষার এ সৌভাগ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। দক্ষিণ ভারতে থেকে আগত সেনরা একাদশ শতাব্দীতে পালদের পরাজিত করে সেন রাজত্ব কায়েম করে সেখানে জাতি ভেদ প্রথা প্রতিষ্ঠা করে সংস্কৃত ভাষাকে রাজভাষা ঘোষণা করে। সরকারি কাজকর্মে সংস্কৃতি ভাষা চালু করার সাথে সাথে মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের প্রতি নিরুৎসাহিত করা শুরু হয়। রাজপুরুষদের চাপে পড়ে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা ফতোয়া জারি করলেন- “অষ্টাদশ পরাণাননি রামস্যস চবিতনিচু/ভষায়ং মানং শ্রুত রৌরবং নরক ব্রজেং”। অর্থাত, অষ্টাদশ পুরাণ ও রামায়ণ যে মানব রচিত বাংলা ভাষায় শ্রবণ করবে, সে রৌরব নরকে নিক্ষিপ্ত হবে। (অধ্যাপক আবদুল গফুর, বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মুসলমান:৮৯)

১২০৩ সালে ইখতিয়র উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী বঙ্গ বিজয়ের মাধ্যমে এদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে ইসলামের সাম্য-ভ্রাতৃত্বের বৈপ্লবিক আদর্শের প্রভাবে জাতিভেদ-লাঞ্ছিত বাংলার সমাজদেহে যেমন নীরব বিপ্লব দেখা দেয়, তেমনি বাংলা ভাষা চর্চায়ও এক নয়া দিগন্তের সৃষ্টি হয়। এ সম্বন্ধে বিখ্যাত গবেষক ড. দীনেশ চন্দ্র সেন বলেন- “হীরা কয়লার খনির মধ্যে থাকিয়া যেমন জহুরীর আগমানের প্রতীক্ষা করে, শুক্তির ভিতর মুক্তা লুকাইয়া থাকিয়া যেরূপ ডুবুরীর অপেক্ষা করিয়া থাকে, বাংলাভাষা তেমনি কোন শুভদিন, শুভক্ষণের জন্য প্রতীক্ষা করিতে ছিলো, মুসলিম বিজয় বাংলা ভাষার সেই শুভ দিন শুভক্ষণের সুযোগ আনায়ন করিল।” (বাংলা ভাষার উপর মুসলমানের প্রভাব, শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন)

মুসলিম শাসনামলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সাহিত্যসেবীগণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। মুসলিম শাসনের পতনের যুগে উত্তর ভারতের মুসলিম শিক্ষিত সমাজের উদ্যোগে আরবী হরফ, আরবী-ফার্সী শব্দ ভাণ্ডারে এবং হিন্দী উচ্চারণকে কেন্দ্র করে ‘উর্দু’ নামে একটি ভাষার উদ্ভব হয় এবং তা অল্প দিনের মধ্যে উত্তর ভারতের সংকৃতবহুল হিন্দুদের ব্যবহৃত হিন্দী ভাষার মুসলিম বিকল্প হয়ে দাঁড়ায়। ১৭৫৭ সালে পলাশী বিপর্যয়ের পর বাংলাদেশে ইরেজ শাসনের সূত্রপাত ঘটে। উনিশ শতকের শুরুতেই ইংরেজ শাসকরা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করে সেখানে ব্রাহ্মণ সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের সহায়তায় বাংলা ভাষা থেকে মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত আরবী-ফার্সী শব্দ বাদ নিয়ে সংস্কৃত কণ্টকিত অভিনব বাংলা ভাষা গড়ে তোলার চেষ্টা চালায়। মুসলিম কবি-সাহিত্যিকরা একটু দেরিতে হলেও এই যড়যন্ত্র প্রতিহত করেন। মীর মোশাররফ হোসেন, শেখ আবদুর রহিম, মহাকবি কায়কোবাদ প্রমুখ তাদের অন্যতম।

বাংলা ভাষার শৈশব ও কৈশোরে এই ভাষার লালন ও উন্নয়নে মুসলিম শাসকদের যেমন ছিলো ঐতিহাসিক অবদান, তেমনি বৃটিশ শাসনের অবসানে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার সংগ্রামেও মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব বঙ্গের তরুণ সমাজ আরেক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। যারা বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ঢাকার রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে বাংলা ভাষার শেকড়কে মজবুত করে গিয়েছেন তারা সবই ছিলেন মুসলিম তরুণ। এক কথায় বলা যায়, বাংলা ভাষার শৈশব-কৈশর থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে মুসলমানদের গৌরবজনক অবদান।

বিংশ শতাব্দিতে বৃটিশ-ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকলে নতুন করে বাংলা ভাষার ভবিষ্যত নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষ পর্যায়ে তখন কংগ্রেস নেতা এম. কে গান্ধী একবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে চিঠি লিখে জানতে চান, ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর তার সাধারণ ভাষা কী হতে পারে। রবিন্দ্রনাথ ভারতের সাধারণ ভাষা হিসাবে হিন্দীর পক্ষে তার অভিমত জ্ঞাপন করেন। (রবীন্দ্র বর্ষপঞ্জী, প্রভাত মুখোপাধ্যায়, কলিকাতা, ১৯৬৮, পৃ. ৭৮) ১৯৭১ সালে রবিন্দ্রনাথ এ বিষয়ে আলোচনার জন্য শান্তি নিকেতনে এক আলোচনা সভার আহবান করেন। সে সভায় ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। প্রবন্ধে তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেন যে, ভারতবর্ষে সাধারণ ভাষা হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে তিনটি ভাষার; বাংলা, উর্দু ও হিন্দী। (মোসলেম ভারত, কলিকাতা, বৈশাখ ১৩২৭ বাং) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মনীষী সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকেই স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে যাই হোক, বাংলাদেশে বাংলাই হবে সরকারী ভাষা।

১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পর মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব বঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সেদিন বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপিত হলেও হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গ থেকে অদ্যবধি বাংলাকে ভারতের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার কোনোও দাবি উত্থাপিত হয়নি।

১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে আটচল্লিশ ও বায়ান্ন হয়ে ছাপ্পান্ন সালে পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায় না হওয়া পর্যন্ত প্রধানত পূর্ব বঙ্গের তরুণ মুসলিম সমাজই এই সংগ্রামের নেতৃত্ব দান করেন। বায়ান্নর ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার দাবিতে যে তরুণেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে এ আন্দোলন শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে ছিলেন। তারা সবাই ছিলেন মুসলমান।

বাংলা ভাষার শৈশব ও কৈশোরে এই ভাষার লালন ও উন্নয়নে মুসলিম শাসকদের যেমন ছিলো ঐতিহাসিক অবদান, তেমনি বৃটিশ শাসনের অবসানে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার সংগ্রামেও মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব বঙ্গের তরুণ সমাজ আরেক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। যারা বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ঢাকার রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে বাংলা ভাষার শেকড়কে মজবুত করে গিয়েছেন তারা সবই ছিলেন মুসলিম তরুণ। এক কথায় বলা যায়, বাংলা ভাষার শৈশব-কৈশর থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে মুসলমানদের গৌরবজনক অবদান।

আরো পড়ুন পোস্ট করেছেন

Comments

লোড হচ্ছে...
শেয়ার হয়েছে