বিবাহ করতে ইচ্ছুক মুসলিম ভাইদের জন্য জরুরী জ্ঞাতব্য বিষয়।

লেখকঃ আব্দুল্লাহ আল মাছুম।
——————————————————–

বিবাহের একটি গুরুত্বপূণ বিষয় হল, কাবিন নামার আঠারো নং ধারা পূরণ।

এর মাধ্যমে স্ত্রীকে প্রয়োজনের সময় তালাক গ্রহণের অধিকার প্রদান করা হয়। কিন্তু কাবিন নামার উক্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারাটি আমাদের সমাজে অনেক ক্ষেত্রেই সঠিকভাবে পূরণ করা হয় না। যার ফলে দেখা যায় মহিলারা অহরহ তালাক গ্রহণ করে। হুট করে তালাক নোটিশ পাটিয়ে দেয়। এরপর আফসোস করে।

এক জরীপে প্রকাশ যে, শহরে মেয়েদের পক্ষ থেকে তালাকের ঘটনা বেশি ঘটছে। এর থেকে বাচার উপায় হল , সঠিকভাবে এ ধারটি পুরন করা। এবঅং এ সংক্রান্ত যেসব ভুল-ভ্রান্তি রয়েছে তা থেকে বেচে থাকা। নিম্নে এ সংক্রান্ত ভুলগুলো উল্লেখ করা হল,

১.
বিবাহের অনেক কাযীই উক্ত ধারা পূরণ করার সময়, ‘তিন তালাক গ্রহণের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে বলে লিখে দেয়।’
এটি ভুল।

কারণ, উক্ত ক্ষমতাবলে পরবর্তীতে স্ত্রী যখন সামান্য কারণেই তিন তালাক গ্রহণ করে বসে তখন চাইলেও ওই স্বামীর সাথে পুনরায় ঘর সংসার করার সুযোগ থাকে না। তাই ধারাটা এমনভাবে লেখা উচিত যেন, সহজে আসল উদ্দেশ্য হাসিল হয়,অথচ অতিরিক্ত ক্ষমতা পেয়ে ক্ষতিও যেন না হয়। এজন্য এক্ষেত্রে কেবল এক তালাকে বায়েন গ্রহণ করার ক্ষমতা অপর্ণ করা উচিত। এতে এ ধারার উদ্দেশ্যও হাসিল হবে আবার বিবাহ বিচ্ছেদের পর পুনরায় ঘর সংসার করতে চাইলে সে সুযোগও বাকী থাকবে।

২.
ধারায় লেখা আছে, কী কী শর্তে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অপর্ণ করা হয়েছে?
এক্ষেত্রে শর্তগুলো ভেবে-চিন্তে লেখা হয় না। শর্তের ব্যাপারে ছেলে বা মেয়ে পক্ষের মতামত নেয়া বা শর্তগুলো সুচিন্তিতভাবে লেখার চেষ্টা করা হয় না। গদবাধা কিছু শর্ত লিখে দেয়া হয়। সাধারণত যেসব শর্ত লেখা হয় তন্মধ্যে বহুল প্রচলিত একটি শর্ত হলো, ‘বনিবনা না হলে স্ত্রী তালাক গ্রহণ করতে পারবে’।

একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায়, শর্তটি খুবই হালকা। এবং অনেকটা বিনা শর্তে তালাক গ্রহণের ক্ষমতা অপর্ণ। কেননা প্রতিটি বৈবাহিক সম্পর্কেই কিছু না কিছু মনোমালিন্য হয়েই থাকে। যা অস্থায়ী। কিছুক্ষণ পর সব ঠিক হয়ে যায়। অথচ এ পরিস্থিতিতেও ‘বনিবনা না হলে’ এ শর্ত পাওয়া যায়। স্ত্রী বলতে পারে যে, এতটুকুতেই তার সাথে আমার বনিবনা হয়নি। তাই তালাক দিয়েছি। অথচ হালকা মনোমালিন্যে স্ত্রীর তালাক গ্রহণের ক্ষমতা সৃষ্টি হওয়া অনাকাক্সিক্ষত, অনভিপ্রেত। কেউ চায় না অল্পতেই সংসার ভেঙ্গে যাক। কিন্তু উক্ত গদবাধা শর্তের কারণে দেখা যায় অল্পতেই সংসার ভেঙ্গে যায়। স্ত্রী তিন তালাক গ্রহণ করে বসে। বলাবহুল্য, তিন তালাকের পর একসাথে থাকার সুযোগ আর বাকী থাকে না।

মনে রাখবেন, তালাক গ্রহণ ও প্রদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি এ ধরনের হালকা শর্তে শর্তযুক্ত হওয়া কখনোই কাম্য নয়। এক্ষেত্রে এমন কিছু শর্তারোপ করা যেন কেবল প্রয়োজনের মুহুতের্ স্ত্রী এমন ভাবে তালাক গ্রহণ করে পরে যেন আফসোস করতে না হয়।

৩.
তালাক গ্রহণের ক্ষমতা সম্পূর্ণরুপে স্ত্রীর এখতিয়ারে দেয়া হয়। তালাক গ্রহণের আগে নিজ অভিভাবকদের সাথে পরামর্শ গ্রহণের কথা বলা হয় না। এটিও ঠিক নয়। তালাক গ্রহণের আগে স্ত্রী যদি নিজ অভিভাবকের সাথে বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করে তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাবে অভিভাবকদের হস্তক্ষেপে আপোষ মীমাংসায় বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। তালাক গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন হবে না । এবং এতে পূর্বাপর চিন্তা না করে হুট করে তালাক গ্রহণের পথও বন্ধ হবে।

‘আয়াতে তাখয়ীর’..(সুরা আহযাব, )…. নাযিল হওয়ার পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আম্মাজান আয়েশা সিদ্দীকা রা.কে ‘দুনিয়ার অর্থ-বিত্ত চাও না আমাকে চাও’ এ প্রস্তাব দেয়ার সময় বলেছিলেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তুমি তাড়াহুড়ো করো না। তুমি তোমার আববা-আম্মার সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিও। (বিস্তারিত দেখুন:…সহীহ মুসলিম..)
উক্ত হাদীসে প্রিয় নবী বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে নিজ অভিভাবকের সাথে পরামর্শ গ্রহণের কথা বলেছেন। এর থেকে প্রমাণিত হয়, স্ত্রীদেরকে তালাক গ্রহণের ক্ষমতা অর্পণের সময়‘অভিভাবকদের সাথে পরামর্শ গ্রহণ সাপেক্ষে ’ এ শর্ত জুড়ে দেয়া উচিত। যেন তালাকের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীরা তাড়াহুড়া না করে, ভুল না করে। ।

৪.
উক্ত ক্ষমতা বলে স্ত্রী যখন তালাক গ্রহণ করে তখন অনেকে ডিভোর্স লেটারে বিষয়টি এভাবে লিখে যে, ‘‘আমি অমুককে তালাক দিলাম, কিংবা “ডিভোর্স দিলাম” এটিও ভুল।
বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তই যদি চূড়ান্ত হয় তাহলে স্ত্রী উক্ত ধারানুযায়ী তালাক গ্রহণের কথা এভাবে বলবে, কিংবা এভাবে লিখবে, “ আমি কাবিন নামার ১৮ নং ধারায় স্বামী কর্তৃক প্রদত্ব ক্ষমতা বলে নিজ নফসের উপর এক তালাকে বায়েন গ্রহণ করলাম। ”
‘তালাক দিলাম’ বা ‘ডিভোর্স দিলাম’ এসব শব্দ বলবে না। কারণ, ইসলামী আইন অনুযায়ী , তালাক প্রদান করে স্বামী। স্ত্রী নয়। স্ত্রী তালাক গ্রহণ করে। প্রদান করে না। এজন্য অনেকের মতে, এভাবে তালাক স্ত্রী তালাক দিলে তালাক গ্রহণ কার্যকর হয় না।

উল্লেখ্য, কাবিন নামার উক্ত ধারায়ও লেখা আছে, ‘তালাক প্রদানের ক্ষমতা…) এখানে এভাবে লেখা উচিত, ‘‘স্বামী স্ত্রীকে নিজ নফসের প্রতি তালাক গ্রহণের ক্ষমতা অপর্ণ করিয়াছে কি না? করিয়া থাকিলে কী কী শর্তে?” আশা করি পারিবারিক আদালত বিষয়টি আমলে নিবেন।

৫.

অনেকে ধারাগুলো পূরণ করার আগেই সাদা কাগজে দস্তখত করে দেয়। কিংবা বিবাহের কাযীরা করিয়ে নেয়। এরপর কাযীরা ধারাগুলো (বিশেষ করে ১৮ নং ধারাটি) নিজেদের মত করে পূরণ করে নেয়। এটিও ভুল।

বিবাহ একটি চুক্তি। একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি। আর যে কোন চুক্তিই শরীয়তে লিখিত হওয়া কাম্য। শরীয়তে যেমন এর গুরুত্ব রয়েছে তেমনি দুনিয়ার আইনেও এর গুরুত্ব আছে। কাবিন নামা হল বিবাহ চুক্তির লিখিত রুপ।
অতএব এটি চুক্তির নিয়মানুযায়ী পূর্ণ করা উচিত। তা হল, আগে সবগুলো ধারা ছেলে ও মেয়ে (কিংবা মেয়ের পক্ষের অভিভাবক) কর্র্র্তৃক পূরণ হবে । এরপর উভয়ে দস্তখত করবে।
অবশ্য এক্ষেত্রে সাদা কাগজে দস্তখত দিয়ে দেয়ার অর্থ যেহেতু ‘ধারাগুলো পূর্ণ করার অনুমতি প্রদান’ তাই ফিকহের দৃষ্টিতে এ দস্তখত গ্রহণযোগ্য। তবে এটি নিয়ম পরিপন্থি। অতএব এমনটি না করাই কাম্য।

১৮ নং ধারা পূরণের সঠিক পদ্ধতি:

স্ত্রী যেন নিজ নফসের প্রতি তালাক গ্রহণে তাড়াহুড়ো না করে, ভেবে-চিন্তে তালাক গ্রহণ করতে পারে, পরে যেন আফসোস করতে না হয় এজন্য একটি ভারসাম্য পন্থায় ধারাটি পূরণ করা উচিত। যেন প্রয়োজন ছাড়া সামান্য রাগ হলেই স্ত্রী তালাক গ্রহণ করতে না পারে। আবার স্বামীও যেন স্ত্রীকে আটকে রেখে জুলুম নির্যাতন না করতে পারে।

উক্ত বিবেচনায় ধারাটি পূরণের সময় নিমোক্ত বিষয়গুলো প্রতি লক্ষ্য রাখা জরুরী-

সর্বোচ্চ এক তালাকে বায়েনের ক্ষমতা অর্পণ করা।

উক্ত ক্ষমতর বাস্তবায়ন স্ত্রীর অন্তত একজন অভিভাবকের সাথে পরামর্শ ও অনুমতি সাপেক্ষে হওয়া।

তালাক গ্রহণের ক্ষমতা অর্পণটি সুচিন্তিত শর্তসাপেক্ষে হওয়া। প্রচলিত হালকা,গদবাধা শর্ত না
হওয়া।

১৮ নং ধারা (অন্যান্য ধারাও) পূরণ করার পর দস্তখত করা।
উক্ত বিষয়গুলো সামনে রেখে আমরা উক্ত ধারাটি নি¤েœাক্ত ভাবে পূরণ করতে পারি-

(নিম্নে ১৮ নং ধারা পূরণের একটি নমুনা পেশ করা হল)

“স্বামী স্ত্রীর বিরোধ যদি এ পর্যায়ে পৌঁছে যে তারা একে অপরের হক যথযথভাবে আদায় করতে পারছে না। তাহলে উভয় পক্ষের অভিভাবকদের নিয়ে প্রথমে সমঝোতা বৈঠক করতে হবে। এতে যদি উভয় পক্ষকে মিলিয়ে দেয়া সম্ভব না হয় তাহলে পাত্রী পক্ষের এক বা একাধিক অভিভাবক যদি তাদের একত্রে অবস্থানের চেয়ে পৃথক হয়ে যাওয়াকে শ্রেয় মনে করেন তবে তখন স্ত্রী নিজ নফসের উপর কেবল এক তালাকে বায়েন গ্রহণ করতে পারবে।”

সংক্ষেপে এভাবেও লেখা যেতে পারে-

“হাঁ, এক তালাকে বায়েন গ্রহণের ক্ষমতা অর্পণ করা হল, এশর্তে যে,মনোমালিন্য যদি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে,পাত্রী পক্ষের অন্তত একজন অভিভাবক যদি তাদের একত্রে অবস্থানের চেয়ে পৃথক হয়ে যাওয়াকে শ্রেয় মনে করেন তবে তার লিখিত অনুমোদন সাপেক্ষে তখন স্ত্রী নিজ নফসের উপর কেবল এক তালাকে বায়েন গ্রহণ করতে পারবে।”

প্রকাশ থাকে যে, স্ত্রী কর্তৃক তালাক গ্রহণের ব্যাপারে অভিভাবকের অনুমতি লিখিত হওয়া এ জন্য শর্ত যে, পরবর্তীতে যেন এ ব্যাপারে ফতোয়া বা রায় পেতে কো ঝামেলা না হয়।
উক্ত পন্থায় ধারাটি পূর্ণ করলে যে ফায়দা হবে তা হল,

তালাক গ্রহণে তাড়াহুড়ো হবে না।

কেবল এক তালাকে বায়েন গ্রহনের কারণে পরবর্তীতে পুনরায় একসাথে থাকার সুযোগও বাকী থাকবে।

অতএব এ ব্যাপারে সকলেরই সচেতন হওয়া জরুরী। বিশেষ করে যারা বিবাহ রেজিস্ট্রি করেন , বিবাহ পড়ান তাদের সচেতন হওয়া খুব জরুরী। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।

আরো পড়ুন পোস্ট করেছেন

Comments

লোড হচ্ছে...
শেয়ার হয়েছে