লেখকঃ আব্দুল্লাহ আল মাছুম।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
শুরু কথা,
—————————————————————————-
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ দ্বীন। প্রতিটি মানবের জন্য পরিপূর্ণ গাইড লাইন। মহান আল্লাহ সুবহানাহু ও তা’আলা আমাদেরকে শুধু সৃষ্টিই করেননি;বরং সৃষ্টির পর আমরা কিভাবে চলব এর জন্য একটি পরিপূর্ণ দিক-নির্দেশনাও প্রদান করেছেন। কুরআন ও সুন্নাহ হল সেই মৌলিক দিক-নির্দেশনা।
দিক-নির্দেশনার প্রয়োজন কেন হল?
——————————————————————————
মানবজাতি অন্যান্য সৃষ্টির মত নয়। মানুষকে ভাল-মন্দ দু’ধরনের কাজ করার যোগ্যতাই প্রদান করা হয়েছে। ফেরেশতার মত এমন করা হয়নি যে,কেবল ভাল কাজই করবে। আবার শয়তানের মত এমন করা হয়নি যে, কেবল মন্দ কাজই করবে। মানুষ বরং উভয় শক্তির সমষ্টির নাম। ভাল ও মন্দ উভয় কাজ করার যোগ্যতাই তার রয়েছে। কেন এমন করা হল-সে প্রশ্ন অবান্তর। সষ্ট্রা আমাকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব দান করেছেন-এটিই বড় পাওয়া।
উদাহরণ:
ঔষধ আমরা সবাই ব্যবহার করি। ঔষধের প্যাকেটে লেখা থাকে-‘সব ধরনের ঔষধ শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন’। এছাড়া ঔষধ ব্যবহারের সঠিক নির্দেশনাও প্রদান করা হয়ে থাকে। কারণ ঔষধ ভাল-মন্দ উভয় কাজে ব্যবহার করা যায়। ভাল কাজে এর ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্যই সঠিক নির্দেশনা প্রদান করার প্রয়োজন হয়। মানুষের জীবনটা এমনই। ভাল কাজে জীবনের ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্যই কুরআন-হাদীস নামক দিক-নির্দেশকের প্রয়োজন হয়েছে।
যুগে যুগে দিক-নির্দেশনা:
———————————————————————————–
পৃথিবীর বুকে মানুষের সূচনালগ্ন থেকেই মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা নবী-রাসূল
প্রেরণের মাধ্যমে মানবজাতিকে সঠিক দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছেন। ভাল পথ ও মন্দ পথ িচহ্নিতি করে দিয়েছেন। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত এ ধারা অব্যহত থাকে। নবীজীর পরে নবীজীর রেখে যাওয়া পথের আলোকে যুগে যুগে নবীর ওয়ারীশ তথা উলামায়ে উম্মত এ কাজ আঞ্জাম দিয়ে আসছেন। ইসলামের আলোকে তাঁরা িচহ্নিতি করে দিয়েছেন-কোন পথটি ভাল। আর কোন পথটি মন্দ।
হালাল ও হারাম :
———————————————————————————
উক্ত ভাল ও মন্দকেই ইসলামি পরিভাষায় যথাক্রমে হালাল ও হারাম বলা হয়। হালালকে ‘জায়েয’ও বলা হয়। আর হারামকে ‘নাজায়েয’ও বলা হয়। এছাড়া হারামকে নিমোক্ত নামেও ব্যক্ত করা হয়-
আলহুরমাতু,আলমা’ছিয়্যাতু,আয-যান্বু ও আলকাবীহু ইত্যাদি।
পারিভাষিক পরিচিতি:
——————————————————————————————–
হালাল-একটি ইসলামিক পরিভাষা। ইসলামের দৃষ্টিতে এর দ্বারা যা বুঝানো হয়,তা হল-
حكم الله تعالى بأن فعلا ما هو حلال
“আল্লাহর বিশেষ বিধান,যা কোন কাজ আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুমোদিত হওয়া বুঝায়।”
(তাফসীরে কুরতুবী,খ.১০,পৃ. ১১৬; আলমাওসুয়াতুল ফিকহিয়্যা আল কুয়েতিয়্যা ,খ.১০,পৃ.২৫৩)
আর হারাম হল-
الحرام هو ما طلب الشرع تركه على وجه الحتم والإلزام
“হারাম হল, অনিবার্যভাবে শরীয়ত যে কাজটা না হওয়াকে কামনা করে”।
(আলমাওসুয়াতুল ফিকহিয়্যা আল কুয়েতিয়্যা ,খ.১০,পৃ.২০৬;আলফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু,খ.১,পৃ. ৬৮)
হালাল- হারাম কে সাব্যস্ত করবে?
—————————————————————————-
কোনটি মানুষের জন্য হালাল,কোনটি হারাম এটি একমাত্র মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলাই বলতে পারেন। তিনিই একমাত্র এর অথরাইজড সত্তা। অন্য কোন মাখলূখ তা করতে পারে না। তাইতো শরীয়ত স্বীকৃত কোন হালালকে হারাম সাব্যস্ত করতে নিষেধ করা হয়েছে।
মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আদেশ করেছেন-
“হে মুমিনগণ,আল্লাহ তোমাদের জন্য যে সকল উৎকৃষ্ট বস্তু হালাল করেছেন তাকে হারাম সাব্যস্ত করো না। এবং সীমালংঘন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালংঘনকারীদের ভালবাসেন না।”
(-সূরা মায়িদা-৮৭)
হাঁ, নবী-রাসূলগণ আল্লাহর ওহীপ্রাপ্ত হয়ে বলে দেন- কোনটি হারাম , কোনটি হালাল। এটি প্রকারান্তরে আল্লাহরই বিধান। তদ্রƒপ উলামায়ে উম্মতও কুরআন ও হাদীসের আলোকে নিজ নিজ যামানায় উদ্ভাবিত কোন কোন বিষয়কে হালাল বা হারাম বলেন। এটিও মূলত আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়তেরই অনুসরণ।
উক্ত আয়াতে হালালকে হারাম করতে নিষেধ করা হয়েছে। অনেককেই দেখবেন-কসম করে,অমুক বৈধ জিনিষ খাবে না। স্ত্রীর সাথে রাগ করে কসম করে বলে-অমুক (বৈধ) জিনিষ খাবে না। তাই প্রসঙ্গক্রমে এখানে হালালকে হারাম করার স্তর বুঝে নেয়া উচিত।
হালালকে হারাম করার তিনটি স্তর :
—————————————————————————–
কোন হালালকে হারাম করার তিনটি স্তর রয়েছে। যথা-
এক.
শরীয়তের অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত কোন হালাল বিষয়কে হারাম জ্ঞান করা। জেনে-বুঝে এমন হালালকে হারাম ইতিকাদ ও বিশ্বাস করলে তা হবে কানূনে ইলাহির স্পষ্ট বিরোধিতা। এটি কুফুরী বিশ্বাস।
দুই.
বিশ্বাস নয় ; বরং কথায় কসম করে কোন হালালকে হারাম করা। যেমন কসম করল, অমুক বৈধ খাবার আর খাবে না। অথবা অমুক বৈধ কাজ আর করবে না। অথবা অমুক বৈধ কাজ নিজের উপর হারাম করল।
এর বিধান হল, প্রয়োজন ছাড়া এমন কসম করা গুনাহ। এমন ক্ষেত্রে জরুরী হল, কসম ভেঙ্গে কসমের কাফ্ফারা আদায় করা। (কসমের কাফ্ফারার জন্য দেখুন-সূরা মায়িদা: ৮৯)
তিন.
বিশ্বাসেও নয়;কথা বা কসমেও নয়। বরং কর্মের মাধ্যমে কোন বৈধ কাজকে চিরদিনের জন্য ছেড়ে দেওয়া। কোন হারামকে যেমন ছাড়া হয়,তেমন বৈধ কোন কিছুকে ছেড়ে দেওয়া। যেমন কেউ চিরদিনের জন্য পোলাও ভাত খাওয়া ছেড়ে দিল।
এর বিধান হল-
হালাল কিছুকে ছেড়ে দেওয়া যদি সওয়াবের কাজ মনে করে করা হয় তবে তা হবে বেদআত । বৈরাগ্যবাদের অনুসরণ । যা শরীয়তে নিষিদ্ধ। এর গুনাহ অনেক বড়। আর যদি উপরোক্ত বিশ্বাসে না ছাড়া হয়;বরং শরীর বা আত্মার কোন রোগের কারণে ছাড়া হয় তবে এতে কোন গুনাহ নেই। যেমন অনেকে ডায়বেটিস রোগের কারণে আজীবন মিষ্টি খাওয়া ছেড়ে দেয়। এতে কোন সমস্যা নেই। বরং মাকাসিদের শরীয়ার অন্যতম একটি শাখা ‘আস্সিহ্হা’ রক্ষার জন্য তা করাই কাম্য।
(বিস্তারিত দেখুন,মা’য়ারিফুল কুরআন,মুফতী শফী রহ.,খ.৩,পৃ. ২২০)
হালাল-হারাম বলা একটি স্পর্শকাতর বিষয়:
———————————————————————————-
হালাল-হারাম অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। এটি একমাত্র মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ও তাঁর পক্ষ থেকে ওহীপ্রাপ্ত হয়ে নবী-রাসূলগণই করতে পারেন। কুরআন মাজীদে স্পষ্টভাবে নিষেধ করা হয়েছে-কোন হালালকে হারাম সাব্যস্ত করতে । এজন্য সালাফে সালেহীন তাঁদের ফতোয়ায় ‘হালাল’,‘হারাম’এ শব্দদ্বয় পারতপক্ষে ব্যবহার করতেন না। ইমাম মালেক রহ. বলেন-
لم يكن من فتيا الناس أن يقول هذا حلال وهذا حرام ولكن يقولون : إياكم كذا وكذا
“সালাফের ফতোয়ার ভাষা এরূপ ছিল না যে, এটি হালাল,এটি হারাম। বরং তারা বলতেন,এমন কাজ করা থেকে অবশ্যই বিরত থাকো।”
ইমাম কুরতবী রহ. বলেন,“এর কারণ এটিই যে, হালাল-হারাম বলা একমাত্র মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কাজ। অন্য কারো নয়।” (তাফসীরে কুরতুবী,খ.১০,পৃ. ১১৬)
মূল থেকে ইসলামী ফিকহ অধ্যয়নের অভ্যাস যাদের আছে, তারা জানেন, ইমাম আবু হানিফা রহ.,ইমাম মালেক রহ., ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ.ও ইমাম শাফেয়ী রহ.এর মত মহান মুজতাহীদগণ তাদের বক্তব্যে হালাল-হারাম শব্দ খুবই কম ব্যবহার করেছেন। এমনকি ইমাম মুহাম্মদ রহ.এর ‘কিতাবুল আসল’,‘মুয়াত্তা’,কিতাবুল হুজ্জা’ প্রমুখ গ্রন্থেও আপনি হালাল-হারাম শব্দ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অথচ কিতাবগুলো লেখাই হয়েছে শরীয়তের মাসআলা বলার জন্য।
আমাদের দেশের আদর্শ ফতোয়া বিভাগগুলোও তাদের ফতোয়ায় হালাল-হারাম শব্দ ব্যবহারে বেশ সচেতন থাকেন।
মোটকথা,হালাল-হারাম অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। এটি হালকা কোন বিষয় নয়। যেনতেন বিষয়ে না জেনে,না বুঝে,অকাট্য দলীল আছে কি না-তা যাচাই না করেই কোন কিছুর ব্যপারে হালাল-হারাম বলা যায় না। এ ব্যাপারে আমাদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা জরুরী।
আমাদের কারো কারো অভ্যাস হয়ে গেছে,কথায়-কথায় হালাল-হারাম শব্দ ব্যবহার করা। এর থেকে বিরত থাকা জরুরী। যেখানে শরীয়তে বিজ্ঞ আলেম ও মুজতাহিদগণই ভয় পান-এ শব্দদ্বয় ব্যবহার করতে,সেখানে আমি-আপনি কোথায়!
হালাল-হারাম বিষয়ে কিছু লেখাও ভয়ের। পূর্ব ওয়াদা না থাকলে এ বিষয় লেখা বন্ধ করে দিতাম। তাই এখানে যা লেখা হবে-এর কোন কিছু নিজের থেকে বলার প্রশ্নই আসে না। শরীয়া বিশেষজ্ঞ সর্বজন স্বীকৃত মণীষীদের রেফারেন্সেই বলার চেষ্টা করব । ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ পাক ভুল-ভ্রান্তি থেকে হেফাযত করুন।
আলোচনার সারকথা :
——————————————————————————
এতক্ষণ আলোচনা থেকে যা বুঝা গেল-
ক. হালাল ও হারাম মহান আল্লাহর হুকুম ও বিধান। তাই কোন হালালকে হারাম বলা বা হারামকে হালাল বলার অর্থ মহান আল্লাহর বিধানে হাতদেয়া, যা জঘন্য । কুফরী কাজ।
খ. হারাম কেবল শরীয়তের অকাট্য দলীল দ্বারাই প্রমাণিত হয়।
গ. হারাম এমন বিষয় যা শরীয়ত নিশ্চিতরূপে না হওয়াকে কামনা করে। এটি এমন যেমন বিষকে নিশ্চিতরূপে নিষেধ করা হয়। তাই হারাম বিষতুল্য।
ঘ. হালাল-হারাম কেবল মহান আল্লাহই সাব্যস্ত করেন। উলামায়ে উম্মত আল্লাহর সেই বিধানকে কেবল নিজ যুগ ও ভাষায় ব্যক্ত করেন। এর বেশি কিছু নয়।
ঙ. হালাল-হারাম অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। সহজে উক্ত শব্দদ্বয় বিশেষ করে হারাম শব্দ ব্যবহার করা ঠিক নয়।
চ. কোন হালালকে হারাম বিশ্বাস করা। কিংবা কোন হারামকে হালাল বিশ্বাস করা। যেমন ব্যাংক সুদকে হালাল বিশ্বাস করা কুফুরী।
ছ. কোন বৈধ বিষয়কে নিজের জন্য কসমের মাধ্যমে হারাম করা অন্যায়।
জ. কোনটি হালাল,কোনটি হারাম তা জানতে হলে-নির্ভরযোগ্য কোন ফতোয়া বিভাগ বা শরীয়া বিশেষজ্ঞ আলেমের শরণাপন্ন হতে হবে। সবচেয়ে ভাল হয়,কোন নির্ভরযোগ্য মুফতীর শরণাপন্ন হওয়া। কারণ একজন মুফতীর কাজই হল-মাসআলা-মাসায়েল নিয়ে ঘাটাঘাটি করা। সেই মুফতী যদি হন কোন ফতোয়া বিভাগে কর্মরত তাহলে তো আরো ভাল। মাসআলা জানার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি স্মরণে রাখা প্রয়োজন।
আগামী পর্বে পড়ুন-
———————————–
কোরআন,হাদীস,আছার ও সালাফের বক্তব্যের আলোকে হালাল ও হারাম।
সহযোগিতায়ঃ ইসলামী অর্থনীতি ফোরাম, বাংলাদেশ।
Comments