ইসলামের দৃষ্টিতে হালাল-হারাম ও হারাম থেকে বেঁচে থাকার মৌলিক নীতিমালা – ২য় পর্ব

লেখকঃ আব্দুল্লাহ আল মাছুম।

কুরআন মাজীদের আলোকে হালাল-হারাম:

—————————————————————–
কুরআন মাজীদে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বিভিন্ন আয়াতে হালাল উপার্জন ও হারাম বর্জনের আদেশ করেছেন। এ সংক্রান্ত দুটি আয়াতের তর্জমা ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা  নিম্নে পেশ করা হল।
১.
يا ايها الذين أمنوا كلوا من طيبات ما رزقناكم ،واشكروا لله إن كنتم إياه تعبدون
হে মুমিনগণ,আমি তোমাদেরকে জীবিকারূপে যে উৎকৃষ্ট বস্তুসমূহ দিয়েছি,তা থেকে (যা ইচ্ছা) খাও এবং আল্লাহর শুকর আদায় কর-যদি সত্যিই তোমরা কেবল তাঁরই ইবাদত করে থাক।”-সূরা বাকারা:১৭২
আল্লামা ইবনে কাছীর রহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন-(তর্জমা): আল্লাহ পাক এ আয়াতে আদেশসূচক শব্দে তাঁর বান্দাদেরকে হালাল গ্রহণ করতে আদেশ করেছেন। এরপর শুকরিয়া আদায় করতেও আদেশ করেছেন। যদি তারা সত্যিই তাঁর বান্দা হয়ে থাকে।
এরপর তিনি বলেছেন-‘হালাল ভক্ষণ দুয়া ও ইবাদত কবুল হওয়ার কারণ’। এ প্রসঙ্গে তিনি একটি হাদীসও উল্লেখ করেছেন। সামনে আমরা তা উল্লেখ করব। (তাফসীরে ইবনে কাছীর,খ.১,পৃ. ৩৫০)
২.
يا ايها الرسول كلوا من الطيبات واعملوا صالح اني بما تعملون عليم
“হে রাসূলগন,তোমরা পবিত্র বস্তসমূহ হতে (যা ইচ্ছা) খাও ও সৎকর্ম কর। তোমরা যা কর নিশ্চয়ই আমি সে সম্পর্কে পূর্ণ অবগত।”-সূরা মুমিনুন:৫১
আল্লামা ইবনে কাছীর রহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন-(তর্জমা): এ আয়াতে আল্লাহ পাক তাঁর সকল রাসূলকে হালাল খেতে আদেশ করেছেন। সাথে নেক কাজ করতেও বলেছেন। এতে প্রতিয়মাণ হয়,
أن الحلال عون على العمل الصالح فقام الإنبياء عليهم السلام بهذا أتم القيام
“ হালাল ভক্ষণ নেক ও সৎ কাজে সহায়ক। আম্বীয়াগণ আলাইহিস সালাম এর উপর পূর্ণরূপে আমল করেছেন।”
সায়িদ ইবনে জুবাইর রহ. ও দাহ্হাক রহ. বলেছেন- উক্ত আয়াতে ‘তোমরা পবিত্র বস্তসমূহ হতে (যা ইচ্ছা) খাও’ এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল-হালাল খাবার। (-তাফসীরে ইবনে কাছীর,খ.৫,পৃ. ৪১৫)
উপরোক্ত আয়াতদ্বয় থেকে যা বুঝা গেল :
———————————————————–
ক. হালাল গ্রহণ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের প্রতি নির্দেশ। সষ্ট্রার নির্দেশ। একজন সাধারণ রাষ্ট্রপতির নির্দেশ যদি হয় অলংঘনীয় তবে সারা জাহানের মহান অধিপতির নির্দেশ…

খ. হালাল গ্রহণ আল্লাহর অনুগ্রহ। তাই শুকরিয়া আদায় করারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। শুকরিয়া আদায় হালাল গ্রহণের চেতনাকে শাণিত করে। আপনি ভাল কাজ করছেন-এ অনুভূতি আরো ভাল কাজে উদ্বুদ্ধ করে। তাই শুকরিয়া আদায়ের বিকল্প নেই।

গ. সত্যিকার আল্লাহর বান্দা তারাই যারা শত কষ্ট সত্ত্বেও মহান আল্লাহর উক্ত নির্দেশ মানতে প্রস্তুত। আপনি নামায পড়েন,রোযা রাখেন,দাড়িও রাখেন,টাখনুর উপর কাপড় তুলেন-তবে হালাল গ্রহণে কষ্ট স্বীকার করতে মন চায় না-এমন আচরণ নেকামী। সত্যিকার বান্দার আচরণ এমন হতে পারে না। লক্ষ্য করুন- আয়াতের অংশ-‘ যদি সত্যিই তোমরা কেবল তাঁরই ইবাদত করে থাক’।

ঘ. হালাল গ্রহণ নেক কাজের সহায়ক। শত ভাল নিয়ত থাকা সত্ত্বেও নেক ও ভাল কাজ আমার দ্বারা হয় না। না হওয়ার একটি অন্যতম কারণ কিন্তু ‘হারাম ভক্ষণ’। সুতরাং ভাবুন…

ঙ. হালাল গ্রহণ দুআ কবুলে সহায়ক। ‘এত করে আল্লাহকে ডাকলাম। চোখের পানি ফেললাম। কই,আল্লাহ তো আমার ডাক শুনল না’-এমন কথা অনেকেই বলে। কিন্তু ভেবে দেখে না-দুআ কেন কবুল হয় না।

——————————————————————–

সহীহ হাদীসের আলোকে হালাল-হারাম:

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদীসে হালাল গ্রহণ ও হারাম বর্জনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। এবার আমরা এ বিষয়ে কিছু সহীহ হাদীস পেশ করব। হাদীসের সনদের ব্যাপারে অধম কিছু না বলে পূর্ববর্তী সর্বজনস্বীকৃত হাদীস বিশারদদের রেফারেন্স উল্লেখ করব। হাদীসের সাথে কিছু ব্যাখ্যাও যোগ করব,যেন হাদীসগুলোর মর্ম উপলব্ধি সহজ হয়। আল্লাহ পাক আমাদেরকে হাদীসের মর্ম বুঝা ও এর উপর আমল করার তৌফিক দান করুন।

১. আনাস বিন মালেক থেকে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
طلب الحلال واجب على كل مسلم
قال الهيثمي رح.:رواه الطبراني في الأوسط،وإسناده حسن(مجمع الزوائد ১০/৩৭৭))
“হালাল অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য জরুরী” (মাজমাউয যাওয়ায়েদ,খ.১০পৃ.৩৭৭)

আল্লামা মুরতাযা যাবীদী রহ. এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেন-
‘উক্ত হাদীসে ‘হালাল অন্বেষণ’এর দুটি অর্থ হতে পারে।

এক. হালাল অন্বেষণের মানে হল-হালাল ও হারামের জ্ঞান অন্বেষণ করা। জানা। কোনটা হালাল,কোনটা হারাম তা জানা। সংক্ষেপে যাকে ইলমিল ফিকহ বা ফেকাহ শাস্ত্র বলে। যেমন প্রসিদ্ধ হাদীস ‘طلب العلم فريضة على كل مسلم “প্রত্যেক মুসলিমের উপর জ্ঞান তালাশ করা ফরয” এখানে তালাশ বা অন্বেষণ দ্বারা উদ্দেশ্য-ফিকহের জ্ঞান জানা। এ ব্যাখ্যার পক্ষে সমর্থন পাওয়া যায় অপর একটি হাদীস থেকে যা ইমাম হাকেম তার তারিখের মধ্যে বয়ান করেছেন। তা হল,طلب الفقه حتم واجب على كل مسلم “ফিকহের জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য জরুরী”।

দুই. নিজের প্রয়োজন পূরণের জন্য হালাল উপার্জন অন্বেষণ করা।’ (ইতহাফু সাদাতিল মুত্তাক্বিন,খ.৬,পৃ.৪)
ইমাম মুহাম্মদ রহ. তাঁর অনবদ্য রচনা ‘কিতাবুল কাসব’শুরু করেছেন এভাবে-“طلب الكسب فريضة على كل مسلم كما أن طلب العلم فريضة
“জ্ঞান অন্বেষণ যেমন ফরয তেমনি হালাল উপার্জন অন্বেষণও তেমনি ফরয” (কিতাবুল কাসব,পৃ. ৭১)
বলা বাহুল্য,জ্ঞান অন্বেষণ ফরয-তা আমাদের বিভিন্ন আলোচনায় উঠে আসে। তবে এরই মত হালাল রুজি অন্বেষণ করাও যে একটি অন্যতম ফরয তা তেমন আলোচনা হয় না।

২. হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-لأن ياخذ
ترابا في فيه خير له من أن يجعل في فيه ما حرم الله عليه
“সেই সত্তার শপত,যার হাতে আমার প্রাণ,তোমাদের আল্লাহ যা হারাম করেছেন এমন কিছু নিজ মুখে ঢুকানোর তুলনায় মুখে মাটি দেয়া অনেক ভাল।” (মুসনাদে আহমদ,খ.২,পৃ. ২৫৭,মাজমাউয যাওয়ায়েদ,খ.১০পৃ. ৩৮০)
قال الهيثمي رح.: رواه أحمد ورجاله رجال الصحيح ،غير محمد بن اسحاق وقد وثق) )
কোন কিছুর গুরুত্ব ও নিশ্চয়তা বুঝানোর জন্য বাক্যে কসম ব্যবহার করা হয়। এখানে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কমস করে,অত্যন্ত জোরালোভাবে বললেন-‘হারাম খাওয়ার চেয়ে মাটি খাওয়া ভাল।’ সুতরাং এখনো যারা সুদ ও অন্যান্য হারামে লিপ্ত তাদের প্রিয় নবীর উক্ত কথাটি চিন্তা করা উচিত।
বারবার উচ্চারণ করুন। জোরে জোরে বলুন- ‘হারাম খাওয়ার চেয়ে মাটি খাওয়া ভাল।’ ‘হারাম খাওয়ার চেয়ে মাটি খাওয়া ভাল।’ ‘হারাম খাওয়ার চেয়ে মাটি খাওয়া ভাল।’…

৩. খলীফায়ে রাশেদ আবু বকর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-لا يدخل الجنة جسد غذي بحرام
“সেই দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না,যাকে তৃপ্ত করা হয়েছে হারাম দ্বারা”।
(মুসনাদে আবু ইয়ালা,৭৮,মাজমাউয যাওয়ায়েদ,খ.১০পৃ.৩৮০)
( قال الهيثمي رح.: رواه أبو يعلى ، والبزار, والطبراني في الأوسط، ورجال أبي يعلى ثقات،وفي بعضهم خلاف)
চিন্তা করা উচিত,হারাম খেয়ে আমি যে বেড়ে উঠছি,আমার এই দেহ জান্নাতে স্থান পাবে কি না। যেই দেহকে কেউ সামান্য আঘাত করলেও আমার সহ্য হয় না। সেই দেহকে হারাম দ্বারা তৃপ্ত করে আমি আমার অজান্তেই তাকে কঠিন আগুনের দিকে এগিয়ে দিচ্ছি। কাজটা কি বুদ্ধিমানের…

৪. আব্দুল্লাহ ইবনে হানযালা রা.থেকে বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে- درهم من الربا أشد عند الله من ستة وثلاثين زينة في الإسلام
“সুদের মাধ্যমে এক দিরহাম বা এক টাকা উপার্জন করার যে গুনাহ,ইসলামে আল্লাহর নিকট সেই গুনাহ ৩৬ বার ব্যভিচারের গুনাহের চেয়েও ভয়াবহ ও মারাত্মক।” (মুসনাদে আহমদ)
قال العراقي رح.: رواه احمد و الدارقطني من حديث عبد الله بن حنظلة ،ورجاله ثقات اهـ كذا في اتحاف السادة المتقين ৬/৯
ব্যভিচারের ভয়াবহতা সকলেরই জানা আছে। সুদ সেই ব্যভিচারের চেয়েও মারত্মক। চিন্তা করলেই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে।

৫. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা.থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- أربع إذاكن فيك ، فلا عليك ما فاتك من الدنيا :حفظ أمانة، وصدق حديث، وحسن خليقة،وعفة في طعمة
“চারটি গুণ যদি অর্জন করতে পার,তাহলে দুনিয়ার অন্যসব কিছু থেকে বঞ্চিত হলেও তোমার কোন দুঃখ নেই,সেই চারটি মহৎ গুণ হল-এক. আমানতের হেফাযত করা। দুই. সত্য কথা বলা। তিন. উত্তম ব্যবহার করা। চার.পবিত্র ও হালাল খাবার গ্রহণ করা। ”(মুসনাদে আহমদ,২/১৭৭,মাজমাউয যাওয়ায়েদ,খ.১০পৃ. ৩৮৩)
قال الهيثمي رح.: رواه أحمد والطبراني، وإسنادهما حسن
দুনিয়ার সব অর্জন করলাম,হালাল অর্জন করলাম না-তাহলে আমি কিছুই পাইনি। সবই হারালাম। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন-এমন বঞ্চনা থেকে।

৬. আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা.থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-সেই সত্তার শফত,যার হাতে আমার প্রাণ,নিশ্চয় মুমিনের দৃষ্টান্ত হল মৌমাছির ন্যায়। মৌমাছি যেমন ভাল আহার করে,ভাল কিছু রেখে যায় তেমনি মুমিনও”(মুসনাদে আহমদ,২/১৯৯)
قال الهيثمي رح.: رواه أحمد ورجاله رجال الصحيح ্
আল্লাহ পাক আমাদের প্রত্যেককে মৌমাছির ন্যয় হওয়ার তৌফিক দান করুন।

৭. হযরত আবু হুরাইরা রা.থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-নিশ্চয়ই আল্লাহ হলেন পবিত্র,উৎকৃষ্ট। তিনি পবিত্র ছাড়া অন্য কিছু কবুল করেন না। তিনি রাসূলদেরকে হালাল গ্রহণের যে আদেশ করেছেন,মুমিনদেরকেও তা আদেশ করেছেন-এরপর তিনি কুরআনের নি¤েœাক্ত আয়াত দ্বয় পাঠ করেন-يا ايها الرسول كلوا من الطيبات واعملوا صالحا
“হে রাসূলগন, তোমরা পবিত্র বস্তসমূহ হতে (যা ইচ্ছা) খাও ও সৎকর্ম কর। তোমরা যা কর নিশ্চয়ই আমি সে সম্পর্কে পূর্ণ অবগত।”-সূরা মুমিনুন:৫১
يا ايها الذين أمنوا كلوا من طيبات ما رزقناكم
“হে মুমিনগণ,আমি তোমাদেরকে জীবিকারূপে যে উৎকৃষ্ট বস্তুসমূহ দিয়েছি,তা থেকে (যা ইচ্ছা) খাও এবং আল্লাহর শুকর আদায় কর-যদি সত্যিই তোমরা কেবল তাঁরই ইবাদত করে থাক।”-সূরা বাকারা:১৭২
এরপর তিনি এক লোকের কথা উল্লেখ করে বলেন,জনৈক মুসাফির দীর্ঘ সফর করেছে। চুলগুলো এলোমেলো,ধুলোময় শরীর। আকাশের দিকে দু হাত তুলে দুয়া করছে। দুয়ায় বলছে,হে আমার রব,হে আমার রব। অথচ তার মাতআম তথা আহার হারাম,মালবাছ তথা পোশাক হারাম,তো যে হারাম খায় ও হারাম পরিধান করে তার দুয়া কিভাবে কুবল হবে। ! (সহীহ মুসলিম,১০১৫)
এ হাদীস থেকে জানা গেল,দুয়া কবুলের পূর্ব শর্ত হালাল ভক্ষণ ও হারাম বর্জন।

৮. হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
ياتي على الناس زمان لا يبالي المرء بما أخذ المال أبحلال أم حرام
“এমন এক সময় আসবে যে, তখন মানুষ কোন পরওয়া করবে না,ভ্রক্ষেপই করবে না-সে কোন ধরনের সম্পদ গ্রহণ করছে-তা হালাল না হারাম।”(সহীহ বুখারী,২০৫৯,২০৮৩)
এটি একটি কেয়ামতের আলামত। বর্তমান অনেক মুসলিমই হালাল-হারামে কোন পরওয়া করে না। নামায হয়ত পড়ে তবে সাথে সুদি ব্যাংকে চাকরীও করে। একটি মুসলিম দেশে সুদী ব্যাংক মূলত কল্পনা করাও কষ্ট। কিন্তু আফসোস! আমাদের দেশে অগণিত সুদী ব্যাংক ও বীমা। আশ্চর্য হল,সেখানে বিধর্মীরা নয়,বরং মুসলিমরা বেশিরভাগ কাজ করছে। হারাম গ্রহণে কোন পরওয়া করছেনা। এ যেন আজ থেকে সাড়ে চোৗদ্দশত বছর আগে বলা প্রিয় নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উক্ত বক্তব্য সত্য হয়ে প্রমাণিত হল।
উপরোক্ত হাদীসগুলো থেকে যা শিখলাম:
————————————————————–

ক. হালাল-হারামের জ্ঞান অর্জন করা ফরয।

খ. হালাল অন্বেষণও ফরয।

গ. আজ থেকে আর হারাম গ্রহণ করবো না। হারাম গ্রহণের চেয়ে মাটি মুখে দেয়া শতগুণে ভাল। আমাদের শ্লোগান হোক-“ হারাম খাওয়ার চেয়ে মাটি খাওয়া ভাল”

ঘ. এক টাকা হারাম খাওয়া ব্যভিচারের চেয়েও জঘন্য।

ঙ. হারাম গ্রহণ দুআ কুবল না হওয়ার কারণ।

আজ থেকে প্রতিজ্ঞা করি,আর নয় হারাম। আজ থেকে শুধুই হালাল আর হালাল । আল্লাহ পাক আমাদের কুবুল করুন।

আছারের আলোকে হালাল-হারাম:
———————————————————–
হাদীসের পরই আছারের গুরুত্ব। উল্লেখ্য, মুতাকাদ্দিমীনদের পরিভাষায় আছার বলতে হাদীসকেও অন্তর্ভুক্ত করে। এজন্য দেখবেন ইমাম মুহাম্মদ রহ. তাঁর অনবদ্য গ্রন্থ ‘আলআসল’এ বিভিন্ন স্থানে ‘আছার’কে হাদীসের অর্থে ব্যবহার করেছেন। তবে বর্তমান সময়ে (অন্তত আমাদের দেশে) সাধারণত সাহাবা,তাবেয়ীনদের বক্তব্য ও আমলকে আছার হিসাবে ব্যক্ত করা হয়। যাই হোক,এখানে মূলত আমরা সাহাবায়ে কেরাম থেকে হালাল-হারাম বিষয়ে কিছু বর্ণনা বা আছার উল্লেখ করব।
খলিফায়ে রাশেদ হযরত আবু বকর রা.:
—————————————-
বর্ণিত আছে যে, খলিফায়ে রাশেদ হযরত আবু বকর রা.একদা তাঁর এক গোলামের উপার্জন থেকে কিছু দুধ পান করেছিলেন। দুধ পান করার পরপরই গোলামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ওই উপার্জন সে কিভাবে করেছে? তা হালাল না হারাম ছিল। গোলাম জবাবে বলল, গণকের কাজ করে উপার্জন করেছে। (বলা বাহুল্য,গণকের কাজ হারাম।) তখন সাথে সাথে তিনি মুখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে বমি করা শুরু করলেন। এমনভাবে বমি করতে লাগলেন,মনে হচ্ছিল তাঁর প্রাণ বের হয়ে যাবে। আর বলতে ছিলেন,হে আল্লাহ,আমি ক্ষমাপ্রার্থী,আমার রগ-শিরা ও পাকস্থলি যা গ্রহণ করেছে-এর জন্য। (সহীহ বুখারী। অন্যান্য বর্ণনা থেকে কিছুটা সংযোজনসহ,আরো দেখুন, ইতহাফু সাদাতিল মুত্তাকিন,খ.৬পৃ.১০)
খলিফায়ে রাশেদ হযরত উমর রা.এর ব্যাপারে বর্ণিত আছে,তিনি একদা না জেনে ভুলে সাদকার উটের দুধ পান করেছিলেন। যখন জানলেন তখন মুখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে বমি করে তা বের করে ফেললেন। (কারণ সাদকা বা যাকাত গ্রহণ তাঁর জন্য বৈধ ছিল না) (মুয়াত্তা মালেক)
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ওই ব্যক্তির নামায কবুল হয় না,যার পেটে রয়েছে হারাম। (ইতহাফু সাদাতিল মুত্তাকিন,খ.৬পৃ.১১)
এধরণে আরো বর্ণনা সাহাবায়ে কেরাম থেকে পাওয়া যায়। এসব বর্ণনা থেকে প্রতিয়মান হয়,তাঁরা হারামকে কতটা জোরালোভাবে প্রতিহত করতেন। মাসআলার দৃষ্টিকোণ থেকে ভুলে এমন দুধ পান করলে তা ইচ্ছাকৃত বমি করে বের করার প্রয়োজন নেই। তবে সর্বোচ্চ তাকওয়ার দাবী হল,তাও বের করা। এখন চিন্তার বিষয় হল,সর্বোচ্চ তাকওয়া তো দূরের বিষয়,সুস্পষ্ট হারাম থেকেও আমরা বেঁচে থাকি না।
সালাফের বক্তব্যে হালাল-হারাম:
—————————————————————
সাহাবায়ে কেরামের ন্যয় পরবর্তী সালাফও হালাল গ্রহণ ও হারাম বর্জনে সচেষ্ট ছিলেন। মূলত এটি সর্বযুগের প্রকৃত মুসলিমের বৈশিষ্ট্য। এমন গুণের মুসলিম পূর্বেও ছিলেন,এখনও আছেন,ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতেও থাকবেন। এখানে আমরা নমুনা স্বরূপ কিছু বর্ণনা পেশ করছি,বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য।
সুফয়ান সাওরী রহ.বলেন,আল্লাহর আনুগত্যে বা নেক কাজে যে ব্যক্তি হারাম অর্থ ব্যয় করে, সে এমন যে নাপাক কাপড়কে পাক করতে চায় পেশাব দ্বারা। অথচ পবিত্র পানি ছাড়া নাপাক পাক হয় না। তদ্রƒপ গুনাহ মাফ হয় হালাল দ্বারা। হারাম দ্বারা নয়। (ইতহাফু সাদাতিল মুত্তাকিন,খ.৬পৃ.১১)
ইমাম মালেক রহ. বলেন, লাখ দিরহাম (বা লাখ টাকা) দান করার তুলনায় আমার নিকট হারাম এক দিরহাম (বা হারাম এক টাকা) ত্যাগ করা অনেক প্রিয় । (ইতহাফু সাদাতিল মুত্তাকিন,খ.৬পৃ.১১)
এমন আরো বর্ণনার জন্য দেখুন- ইতহাফু সাদাতিল মুত্তাকিন,খ.৬পৃ.১০
মোটকথা,সালাফে সালেহীন হালাল গ্রহণ ও হারাম বর্জনে বেশ যত্মবান ছিলেন। তাদের উপরোক্ত বাণীগুলো মনের মধ্যে গেঁথে নিলে ইনশাআল্লাহ শয়তানের বিভিন্ন কুমন্ত্রনা থেকে বেঁচে থাকতে পারবো।
আল্লাহ পাক আমাদেরকে হালাল গ্রহণ ও হারাম বর্জনে তাওফীক দান করুন।
(আন্তরিকভাবে দু:খিত, এ পর্বটি না চাইতেও কিছুট দীর্ঘ হয়ে গেল। আগামী পর্বগুলো সংক্ষেপ করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।দোয়া চাই।
———————————————————-
আগামী পর্বে পড়ুন: হারাম থেকে বাঁচতেই হবে,তবে কিভাবে ?  (হারাম থেকে বেঁচে থাকার মৌলিক নীতিমালা:বাস্তব উদাহারণ ও প্রয়োগক্ষেত্রসহ)

সহযোগিতায়ঃ ইসলামী অর্থনীতি ফোরাম, বাংলাদেশ।

 

আরো পড়ুন পোস্ট করেছেন

Comments

লোড হচ্ছে...
শেয়ার হয়েছে