সুদ নিষিদ্ধ করার মৌলিক কারণ। পর্ব- ১

মূল: মুফতী তক্বী উসমানী সাহেব।
অনুলিপি: মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম।
আসসালামু আলাইকুম,
এই প্রবন্ধটি শ্রদ্ধেয় মুফতী তক্বী উসমানী সাহেবের বই- ”ইসলামের দৃষ্টিতে সুদ ও তার প্রতিকার” থেকে নেওয়া। আমি এখানে বই থেকে হুবহু দিলাম। এটি শেষ করতে অনেকগুলো পর্ব লাগতে পারে।
——————————————————————————————————
সুদ নিষিদ্ধ করার মৌলিক কারণ-
১৩২. এখন আমরা যুক্তিতর্কের ২য় পর্যায়ে আসঠি। সরকারের পক্ষ হতে যুক্তি প্রদর্শন করে বলা হয়েছে যে, ব্যাংক বালিজ্যিক ঋণের সুদে যুলুম ও বে-ইনসাফীর কিছু নেই।
১৩৩. সুদী ঋণ আদান-প্রদানে কি কি জুলুম ও বে-ইনসাফী আছে এ ব্যাপারে স্বয়ং আল-কুরআনই সিদ্ধান্ত দিয়েছে; আর কুরআনুল কারীমের বক্তব্যই যথেষ্ট ও চুড়ান্ত। তাছাড়া সকলের পক্ষে সুদের যাবতীয় কুফল, বে-ইনসাফী ও জুলুম সম্পর্কে জানা, বুঝা ও উপলদ্ধি করতে পারা জরুরী নয়। বলা যায়, আজকের দুনিয়ায় সুদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া যত ব্যাপক ও প্রকট হয়ে উঠেছে, অতীতে কখনও হয়নি। পূর্বকালে সুদী ভোগ্য ঋণ লেনদেন হতো ব্যক্তি পর্যায়ে, আর এর কুফল সীমিত থাকত ঋণ-গ্রহীতা পর্যন্ত। কিন্তু আধুনিককালের সুদী ঋণ ব্যবস্থা যেমন ব্যাপক, এর কুফল, জুলুম ও বে-ইনসাফীও তেমনি বিস্তৃত। এ ঋণের কুফল ছড়িয়ে পড়ে গোটা অর্থনীতিতে, বিপর্যস্ত করে দেয় সমগ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে। বস্তুতপক্ষে,সুদ হারাম হওয়ার কারণগুলো সংখ্যায় এত বেশী যে, এগুলোর বিস্তারিত ফিরিস্তি তৈরী করতে গেলে বিরাট একটি গ্রন্থ হয়ে যাবে। কিন্তু এখানে সে অবকাশ নেই; এখানে আমরা কেবল এর তিনটি দিকের ওপর আমাদের আলোচনাকে সীমিত রাখব। সেগুলো হচ্ছে- ক. তাত্ত্বিক বিচারে সুদ নিষিদ্ধ করার কারণ; খ. উৎপাদনের ওপর সুদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং গ. বন্টনের ওপর সুদের অশুভ প্রভাব।
১৩৪. তাত্ত্বিক কারণ আলোচনায় আমরা দুটো মৌলিক বিষয়ে আলোকপাত করবো। এর প্রথমটি হচ্ছে অর্থের বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি; আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ঋণের বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি।
অর্থের বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি-
১৩৫. সুদের সকল তত্ত্বই ভ্রান্ত অনুমিতির ওপর ভিত্তিশীল। আর এই ভ্রান্ত অনুমিতিগুলেঅর মধ্যে একটি অনুমিতি হলো, এতে অর্থকে একটি পণ্য হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে। এই অনুমিতির ওপর ভিত্তি করেই বলা হচ্ছে, অন্য সকল পণ্যদ্রব্য যেমন বিক্রয় করা যায় তেমনি অর্থকেও ক্রয়-বিক্রয় করা যায়। একজন ব্যবসায়ী যেমন খরচ মূল্যের চেয়ে বেশী দামে তার পণ্য বিক্রি করতে পারে; তেমনি একজন অর্থৈর মালিক তাঁর অর্থকেও ফেস ভ্যালুর চেয়ে অধিক দামে বিক্রি করতে পারে। অথবা কোন ব্যক্তি যেমন তার স্থায়ী সম্পদ ইজারা দিয়ে তার ওপর ভাড়া আদায় করতে পারে, তেমনি অর্থের মালিকও অর্থ ধার দিয়ে তার ওপর সুদ দাবী করতে পারে।
১৩৬. অর্থ সম্পর্কে এরূপ ধারণা বা অনুমিতি ইসলামী নীতিমালার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। অর্থূ অর্থই, আর পণ্য পণ্যই। দুটো সর্ম্পূর্ণ আলাদা। এদের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যও সর্ম্পূর্ণ পৃথক। এ বিষয়ে কতিপয় মৌলিক পার্থক্য সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
ক.অর্থের নিজস্ব কোন উপযোগ নেই। অর্থকে সরাসরি ব্যবহার করে মানুষের কোন প্রয়োজন মেটানো যায় না। অর্থ দ্বারা কেবল অন্য কোন পণ্য বা সেবা ক্রয় করা যায়। অপরদিকে পণ্যসামগ্রীর নিজস্ব উপযোগ আছে। পণ্যসামগ্রী সরাসরি ব্যবহার করে এথেকে উপযোগ লাভ করা যায়। এজন্যে অন্যকোন জিনিসের সঙ্গে একে বিনিময় করতে হয় না বা পণ্যকে রূপান্তর না করেও ব্যবহার করা যায়।
খ. পণ্যসামগ্রীর মধ্যে বহু ধরণের গুণাবলী বর্তমান; কিন্তু অর্থ কেবল মূল্য পরিমাপক বা বিনিময়ের মাধ্যম। এছাড়া আর কোন গুণ অর্থের নেই। সুতরাং কোন মুদ্রার বিশেষ মূল্যমানের সকল একক পরস্পর শতকরা ১০০ ভাগ সমমূল্যের অধিকারী হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ১০০০ টাকার একটি পুরনো ও ময়লাযুক্ত নোটের মূল্য ১০০০ টাকার একটি সম্পূর্ণ নতুন নোটের মূল্যের সমান হয়ে থাকে।
গ. পণ্য তখনি ক্রয়-বিক্রয় হয় যখন তা নির্দিষ্ট ও চিহ্নিত হয়। অর্থাৎ “ক” যদি একটি গাড়ি পছন্দ করে এবং সুনির্দিষ্টভাবে সেই গাড়িটি নির্দিষ্ট করে আর বিক্রেতা তার ক্রয় প্রস্তাবে সম্মত হয়, তাহলে “ক” সেই নির্দিষ্ট গাড়িটি গ্রহল করার অধিকারী হবে। বিক্রেতা তাকে অন্য কোন গাড়ি নিতে করতে পারবে না, যদিও তা একই জাত ও গুণমানের হয়। অন্যদিকে ক্রেতা ও বিক্রেতাকে অন্য গাড়ি সরবরাহ করতে বাধ্য করতে পারবে না, যদিও তা একই জাত ও গুণমানের হয়।
কিন্তু পণ্যসামগ্রীর বিনিময়ে যখন মুদ্রা লেনদেন করা হয়, তখন কোন বিশেষ একটি মুদ্রা বা নোট নির্দিষ্ট করা যায় না। উদাহরণস্বরূপ “ক” ১০০০ টাকার একটি নির্দিষ্ট নোট দেখিয়ে “খ” এর কাছ থেকে কোন পণ্য ক্রয় করা সত্ত্বেও ‘ক’ তার সেই দেখানো নোটটি না দিয়ে অন্য কোন সমমানের নোটের দ্বারাও উক্ত পণ্যের মূল্য পরিশোধ করতে পারবে।
১৩৭. অর্থ ও পণ্যসামগ্রীর মধ্যে বিদ্যমান উল্লিখিত পার্থক্যের কারণে ইসলামী শরীয়ত অর্থকে পণ্যসামগ্রী থেকে আলাদা হিসেবে বিবেচনা করেছে এবং অর্থের জন্যে পৃথক নিয়মনীতি ও বিধান প্রদান করেছে। বিশেষ করে দুটি বিষয়ে-
১৩৮. প্রথমত, পণ্যসামগ্রীর মতো (একই দেশের সম-মূল্যমানের) মুদ্রাকে কোন অবস্থাতেই ব্যবসার পণ্য বানানো যাবে না। অর্থের মৌলিক যে উদ্দেশ্য রয়েছে, অর্থকে কেবল সে উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করতে হবে। এভাবে অর্থের ব্যবহার অর্থের মূল্য উদ্দেশ্যের মধ্যে সীমিত করে দেয়া হয়েছে।
১৩৯. দ্বিতীয়ত, যদি কোন অস্বাভাবিক কারণে অর্থের বদলে অর্থ বিনিময় করতে হয় (একই দেশের) অথবা যদি ঋণ হিসেবে অর্থ লেনদেন করা হয়, তাহলে উভয় পক্ষের লেনদেন অবশ্যই পরিমাণে সমান সমান হতে হবে, যাতে এমন কোন উদ্দেশ্যে অর্থ ব্যবহৃত না হয়, যে উদ্দেশ্যে অর্থ সৃষ্টি করা হয় নাই। অর্থাৎ যাতে খোদ অর্থের ব্যবসা করা না হয়।
১৪০. ইসলামের ইতিহাসে প্রখ্যাত ফকীহ ও দার্শনিক ইমাম গাজালী (মৃত্যু ৫০৫ হিজরী) অর্থের প্রকৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন সেই প্রাচীন কালে। তিনি এ আলোচনা করেছেন সেইকালে যখন পাশ্চাত্য অর্থ তত্ত্বের কোন অস্তিত্বই ছিল না। ইমাম গাজালী তাঁর আলোচনায় বলেছেন-
চলবে……..

আরো পড়ুন পোস্ট করেছেন

Comments

লোড হচ্ছে...
শেয়ার হয়েছে