শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির সফলতা

তানজিল আমির:: সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষ। মানুষকে দেয়া হয়েছে বিবেকবোধ। ভালো মন্দ বোঝার ক্ষমতা এবং সুখ-দুঃখের অনুভূতি। মানুষ ও জিন জাতির জন্য করা হয়েছে জবাবদিহিতার ব্যবস্থা, সব সৃষ্টিই শেষ হয়ে যাবে, শুধু মানুষের বিনাশ নেই। মানুষ ইনতেকাল করে। এক জগত থেকে অন্য জগতে স্থানান্তরিত হয়।  দৈহিক অবকাঠামোকেই মানুষ বলা হয় না,তার ভেতরে রয়েছে এমন শক্তি, যা নিঃশেষ হয়ে যায় না, জায়গা পরিবর্তন করে মাত্র। দেহটা শেষ হয়ে যায়। পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি, সবকিছুই করা হয়েছে এই মানুষের সেবার জন্য। মানুষ ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে আল্লাহর ইবাদাতের জন্য। পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে এ বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে ইবাদত বলতে আমরা নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত ইত্যাদি বুঝিÑ যেগুলো নির্দিষ্ট কিছু সময়ে আমরা পালন করে থাকি। কিন্তু ইবাদাত এই গুটিকয়েক  আমলের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের বিধি-বিধান রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে মানুষের চলার জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা রেখেছেন। মানুষ কীভাবে বাঁচবে, কী খাবে, কী উপার্জন করবে, কীভাবে করবে, কী ব্যয় করবে, কীভাবে ব্যয় করবে, সমাজ পরিচালনা কে করবে, কীভাবে করবে ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ের নির্দেশনা ইসলামে পূর্ণরূপে রয়েছে। মানবজীবনের এমন কোনো দিক নেই, যে ব্যাপারে ইসলামের মৌলিক নির্দেশনা নেই। এসব কিছুর বাস্তব অনুশীলন রাসুল স. নিজে করে এবং সাহাবা রা. এর মাধ্যমে উম্মতকে প্রায়োগিক শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন। ভোরে ঘুম হতে জাগ্রত হওয়া থেকে শুরু করে রাতে আবার ঘুমানো পর্যন্ত প্রতিটি কাজেই আল্লাহর হুকুম ও রাসুল স. এর সুন্নাত রয়েছে আর এ সব হুকুম মান্য করাই ইবাদাত। এই ইহজাগতিক সময়ে মানুষকে কিছুটা স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। তাকে যাচাই বাছাই করার জন্য কিছুটা ছাড়ও দেওয়া হয়েছে। তার সামনে ভালো মন্দের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। মানুষ কোনটা গ্রহণ করে তার ওপর নির্ভর করবে পরকালীন সুখ শান্তির বিষয়টি। আর এ কথাটা মানুষ সৃষ্টির আনন্দে যেন ভুলে না যায়, তাই যুগে যুগে নবি রাসুল প্রেরণ করে সতর্ক করা হয়েছে। নবিগণ ছিলেন সুসংবাদদাতা ও ভীতিপ্রদর্শনকারী। তারা ভালো পথে চললে পরকালীন সুখের সু সংবাদ দিয়েছেন। আবার অবাধ্যকারীদের শুনিয়েছেন কঠোর শাস্তির হুশিয়ারি।
পৃথিবীর শুরুলগ্ন থেকেই আল্লাহপ্রদত্ত জ্ঞান-বুদ্ধি দ্বারা মানুষ অনেক কিছু আবিষ্কার করে চলছে। বিজ্ঞানের এই যুগে চাঁদ ও মঙ্গলে যাওয়ারও প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়েছে, কিন্তু প্রতিটি জিনিসের আবিষ্কারকই তার আবিষ্কার পরিচালনার নির্ধারিত নিয়ম বলেছেন। যতক্ষণ পর্যন্ত ওই বস্তু দ্বারা কাক্সিক্ষত উদ্দেশ্য অর্জন হবে, কিন্তু যখনই নির্ধারিত নিয়মবহির্ভূত তা চালানো হবে, তখনই তা কার্যকারিতা হারাবে এবং তার দ্বারা উপকারের পরিবর্তে ক্ষতি হবে। ঠিক অনুরুপভাবে মানবজাতির সফলতা ও মুক্তি আল্লাহর হুকুম ও রাসুল সা. এর আদর্শের মাঝেই রয়েছে।
মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম নিদর্শন হলো আল্লাহ প্রদত্ত বিবেক-বুদ্ধি, যা মানুষকে ভালো মন্দের পার্থক্য বোঝাতে সাহায্য করে। এ ক্ষেত্রে একজন মানুষের স্বাধীনতা তথা মতগ্রহণের যে ব্যাপারটি, তা অনেকাংশে তার শিক্ষা ও পারিপার্শিক অবস্থার ওপর নির্ভরশীল। ইতিহাসে আমরা এ বিষয়টির সুন্দর ধারণা পাই আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে। আমরা জানি যে, হানাহানি ও অরাজকতা ছিলো যাদের একমাত্র নেশা, খুন ও যুদ্ধবাজি ছিলো যাদের নিত্যদিনের কাজ, গোত্র ও সম্প্রদায়কেন্দ্রিক জাতিগত বিভাজনের মাঝেই যারা বেড়ে উঠতোÑ এক কথায় মানবসভ্যতার ছিটেফোঁটা থেকে হাজার মাইল দূরত্বে যারা ছিলো, তারাই যখন নববি আদর্শের ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করলো, তখন তারা পরিণত হলো  সোনার মানুষে। ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির এমন নজির তারা স্থাপন করলো, ইতিহাস যার উপমা দিতে ব্যর্থ। স্বয়ং আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্টির জানান দিয়ে আয়াত নাজিল করেছেন। আমরা গর্ববোধ করি তাদের উত্তরসূরী হওয়ার গৌরবে। সুতরাং এ বিষয়টি সূর্যের আলোর চেয়ে বেশি সত্য যে, আল্লাহর হুকুম ও রাসুল স. এর আদর্শের মাঝেই মানবতার মুক্তি ও সফলতা।

আজ যদি আমরা সচেতন দৃষ্টিতে ইতিহাসের আয়নায় অতীতের আলোকে আমাদের বর্তমানকে মূল্যায়ন করি, তাহলে খুব সহজেই স্পষ্ট হবে যে, আমরাও কম বর্বতার যুগে নেই। বর্তমান বিশ্বে শিক্ষার আনুপাতিক হার যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এতে যদি আমরা খুব আত্মতৃপ্তি বোধ করি যে, আমরা সভ্যতার উচ্চশিখরে রয়েছি, তাহলে ইতিহাসে আমরা দেখতে পাবো, জাহেলিয়াতের যুগেও শিক্ষার হার কোনো অংশে কম ছিলো না। বরং ইতিহাস তো এমনও বলে যে, জাহেলিয়াতের যুগই ছিলো ভাষা ও সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ যুগ। এমনকি আধুনিক আরবি সাহিত্যও সে যুগের ভাষা সাহিত্যের সামনে বড় অসহায়।
যদি আমরা সে যুগের গোত্র ও সম্প্রদায়কেন্দ্রিক লড়াইয়ের দিকে লক্ষ করি, তাহলে বর্তমান বিশ্বের আধিপত্যের লড়াই আমাদের জাহেলি যুগের কথাই মনে করিয়ে দেয়, সে যুগে গোত্রপতিরা দেশ বিভক্ত করত, কিন্তু বর্তমান রাজনীতির মাধ্যমে দেশ, জাতি, গোষ্ঠী এমনকি পাড়া মহল্লা পর্যন্ত বিভক্ত হয়ে আছে। রাজনৈতিক প্লাটফর্ম বিশ্বমানবতাকে বিভক্ত করে নিজ দলে ভিড়ানোর জন্য বিশেষভাবে কাজ করছে। দুর্নীতি ও কালোবাজারির ক্ষেত্রে প্রত্যেক পার্টির দৃষ্টিভঙ্গি অভিন্ন, কাউকে বলতে শোনা যায় না যে, যা হচ্ছে তা হওয়া উচিত নয়। বরং সবার কথা একটাই, যা হচ্ছে তা আমার নেতৃত্বে ও পৃষ্ঠপোষকতায় হওয়া উচিত। আইন-কানুন উল্টো চলছে, এতে কারো কোনো প্রশ্ন নেই। সকল রাগ ও আপত্তি তো এখানেই যে, যা হচ্ছে তা আমার ছত্রছায়ার হলো না কেন? এই যদি হয় পরিস্থিতি, তাহলে এটাকে কি জাহেলিয়াত বলতে পারি না? আইয়ামে জাহেলিয়াতে কন্যাশিশুদের জীবন্ত দাফন করা হতো, আর আধুনিক জাহেলিয়াতে ছেলে মেয়ে কাউকেই পৃথিবীর আলো বাতাস উপভোগের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না, বরং গর্ভাবস্থায় হত্যা করা হচ্ছে জন্ম নিয়ন্ত্রণের নামে। এটাও কি কম জাহেলিয়াত?
সে যুগে নিজ হাতে খোদা তৈরি করে তার নামে বিভিন্ন বিধান দিয়ে চালিয়ে দেওয়া হতো, আর এ যুগে আল্লাহর বিধান অস্বীকার করে মানবরচিত সংবিধানের মাধ্যমে পরিচালনা করা হচ্ছে বিশ্ব। আবার প্রতিমা বিসর্জনের মতো এর ধারাসমূহ পাল্টে বারবার দোহায় দেওয়া হয় সংবিধানের। সত্যিই যদি এভাবে চলে, তাহলে জাহেলিয়াত বললে কি মিথ্যা বলা হবে?
মোটকথা আল্লাহর হুকুম ও রাসুল সা. এর আদর্শ ছেড়ে অন্য কিছু গ্রহণ করার নামই জাহেলিয়াত। তা সে যুগে যেমন ছিলো এ যুগেও রয়েছে। যুগের হাওয়ায় এর ধরনটা বদলেছে মাত্র।

আরো পড়ুন পোস্ট করেছেন

Comments

লোড হচ্ছে...
শেয়ার হয়েছে