ঈমান সবার আগে… পর্বঃ ৫

১২. ঈমান একটি স্থায়ী অঙ্গিকার, ‘ইরতিদাদ’ সাধারণ কুফরের চেয়েও ভয়াবহ কুফর

ঈমান আল্লাহ ও বান্দাদের মধ্যকার এক স্থায়ী অঙ্গিকারের নাম; যার কোনো মেয়াদ নেই। যখনই ঈমানের সম্পদ পাওয়া গেল তখন থেকেই এর পুষ্টি ও বর্ধন, শক্তি ও সংস্কারে মগ্ন থাকা জরুরি। সবসময় সতর্ক থাকা চাই, এমন কোনো কথা বা কাজ যেন প্রকাশিত না হয়, যা ঈমান নষ্ট করে। আর আল্লাহর দরবারে তাঁর শেখানো দুআ করতে থাকা চাই-

رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ

হে আমাদের প্রতিপালক! সরল পথ প্রদর্শনের পর তুমি আমাদের অন্তরকে সত্যলংঘনপ্রবণ করো না এবং তোমার নিকট হতে আমাদেরকে করুণা দাও, নিশ্চয়ই তুমি মহাদাতা।-আলে ইমরান ৩ : ৮

আল্লাহর কাছে ঐ বান্দার ঈমানই গ্রহণযোগ্য, যে ঈমানের উপর অবিচল থাকে। পক্ষান্তরে যে ঈমান থেকে সরে যায় সে তো দুই বিদ্রোহে লিপ্ত-কুফরের বিদ্রোহ ও ইরতিদাদের বিদ্রোহ।

অবিচল মুমিনদের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে খোশখবরি-

إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ l أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ خَالِدِينَ فِيهَا جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

* যারা বলে, ‘আমাদের প্রতিপালক তো আল্লাহ’ অতঃপর অবিচল থাকে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না। * তারাই জান্নাতের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে, তারা যা করত তার পুরস্কার স্বরূপ।-আল আহকাফ ৪৬ : ১৩-১৪

অন্য আয়াতে আছে-

إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ l نَحْنُ أَوْلِيَاؤُكُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآَخِرَةِ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِي أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُونَ l نُزُلًا مِنْ غَفُورٍ رَحِيمٍ

যারা বলে, ‘আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ’, অতঃপর অবিচলিত থাকে, তাদের নিকট অবতীর্ণ হয়, ফিরিশতা এবং বলে, তোমরা ভীত হয়ো না, চিন্তিতও হয়ো না এবং তোমাদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল তার জন্য আনন্দিত হও। * ‘আমরাই তোমাদের বন্ধু দুনিয়ার জীবনে ও আখিরাতে। সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে যা কিছু তোমাদের মন চায় এবং  সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে যা তোমরা ফরমায়েশ কর। * এটা ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু আল্লাহর পক্ষ হতে আপ্যায়ন।-হামীম আসসাজদা ৪১ : ৩০-৩২

পক্ষান্তরে যারা ঈমানের উপর কায়েম থাকে না; বরং পশ্চাদপসরণ করে কিংবা বারবার এদিক-ওদিক আসা-যাওয়া করে এদের কাছে দ্বীন এক ক্রীড়ার বস্ত্ত! ইরতিদাদ (সত্য ধর্ম থেকে পিছু হটা) মূলত মুনাফিকদের  কাজ। এর দ্বারা তারা দুর্বল ঈমানদারদের সংশয়গ্রস্ত করতে চায়। কুরআন মাজীদে তাদের এই অপকৌশলের বিবরণ আছে।  (দেখুন : আলে ইমরান ৩ : ৭২-৭৩)

যে কোনো ইরতিদাদ সাধারণ কুফর থেকে ভয়াবহ। সাধারণ কুফর তো সত্য দ্বীন থেকে বিমুখ থাকা বা গ্রহণ না করা, কিন্তু ইরতিদাদ নিছক বিমুখতাই নয়, এ হচ্ছে বিরুদ্ধতা। সত্য দ্বীন গ্রহণ করার পর তা বর্জনের অর্থ ঐ দ্বীনকে অভিযুক্ত করা, যা নির্জলা অপবাদ। বরং ইরতিদাদ তো সত্য দ্বীনের প্রতি বিরুদ্ধতার পাশাপাশি ‘ইফসাদ ফিল আরদ’ (ভূপৃষ্ঠে দুস্কৃতি) ও বটে। বিশেষত মুরতাদ (সত্য দ্বীন ত্যাগকারী) যখন কটাক্ষ-কটূক্তি এবং অবজ্ঞা বিদ্রূপে লিপ্ত হয়। এ তো সরাসরি ‘মুহারিব’ (যুদ্ধঘোষণাকারী) ও ‘মুফসিদ ফিল আর্দ’ (ভূপৃষ্ঠে দুস্কৃতিকারী)

মুরতাদ সম্পর্কে কুরআন কারীমের আসমানী হুঁশিয়ারি পাঠ করুন :

إِنَّ الَّذِينَ آَمَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا ثُمَّ آَمَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا ثُمَّ ازْدَادُوا كُفْرًا لَمْ يَكُنِ اللَّهُ لِيَغْفِرَ لَهُمْ وَلَا لِيَهْدِيَهُمْ سَبِيلًا l بَشِّرِ الْمُنَافِقِينَ بِأَنَّ لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا l الَّذِينَ يَتَّخِذُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ أَيَبْتَغُونَ عِنْدَهُمُ الْعِزَّةَ فَإِنَّ الْعِزَّةَ لِلَّهِ جَمِيعًا

যারা ঈমান আনে ও পরে কুফরী করে এবং আবার ঈমান আনে, আবার কুফরী করে, অতঃপর তাদের কুফরী প্রবৃত্তি বৃদ্ধি পায়, আল্লাহ তাদেরকে কিছুতেই ক্ষমা করবেন না এবং তাদেরকে কোনো পথে পরিচালিত করবেন না। * মুনাফিকদেরকে শুভসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি রয়েছে! *মুমিনগণের পরিবর্তে যারা কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারা কি ওদের নিকট ইযযত চায়? সমস্ত ইযযত তো আল্লাহরই।-আন নিসা ৪ : ১৩৭-১৩৯

كَيْفَ يَهْدِي اللَّهُ قَوْمًا كَفَرُوا بَعْدَ إِيمَانِهِمْ وَشَهِدُوا أَنَّ الرَّسُولَ حَقٌّ وَجَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ l أُولَئِكَ جَزَاؤُهُمْ أَنَّ عَلَيْهِمْ لَعْنَةَ اللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ l خَالِدِينَ فِيهَا لَا يُخَفَّفُ عَنْهُمُ الْعَذَابُ وَلَا هُمْ يُنْظَرُونَ l إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ وَأَصْلَحُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ

আল্লাহ কিরূপে সৎপথে পরিচালিত করবেন সেই সম্প্রদায়কে, যারা ঈমান আনার পর ও রাসূলকে সত্য বলে সাক্ষ্য দেওয়ার পর এবং তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শন আসার পর কুফরী করে? আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না, *এরাই তারা যাদের কর্মফল এই যে, তাদের উপর আল্লাহর, ফিরিশতাগণের এবং মানুষসকলের লানত, * তারা তাতে স্থায়ী হবে। তাদের শাস্তি লঘু করা হবে না এবং তাদেরকে অবকাশও দেওয়া হবে না; * তবে এর পর যারা তওবা করে ও নিজেদেরকে সংশোধন করে নেয় তারা ব্যতিরেকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।-সূরা আলে ইমরান ৩ : ৮৬-৮৯

কিন্তু যারা সারা জীবন কুফরের উপর থাকে আর মৃত্যু উপস্থিত হলে তওবা করে তাদের তওবা কবুল হয় না।

إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بَعْدَ إِيمَانِهِمْ ثُمَّ ازْدَادُوا كُفْرًا لَنْ تُقْبَلَ تَوْبَتُهُمْ وَأُولَئِكَ هُمُ الضَّالُّونَ

ঈমান আনার পর যারা কুফরী করে এবং যাদের সত্য প্রত্যাখ্যান-প্রবৃত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে তাদের তওবা কখনো কবুল হবে না। এরাই পথভ্রষ্ট।-আলে ইমরান ৩ : ৯০

আরো ইরশাদ  হয়েছে-

وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ حَتَّى إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ إِنِّي تُبْتُ الْآَنَ وَلَا الَّذِينَ يَمُوتُونَ وَهُمْ كُفَّارٌ أُولَئِكَ أَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا

তওবা কবুলের বিষয়টি তাদের জন্য নয়, যারা অসৎকর্ম করতে থাকে। পরিশেষে তাদের কারও যখন মৃত্যুক্ষণ এসে পড়ে, তখন বলে, এখন আমি তওবা করলাম এবং তাদের জন্যও নয়, যারা কুফর অবস্থায়ই মারা যায়। এরূপ লোকদের জন্য তো আমি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্ত্তত করে রেখেছি।-সূরা নিসা (৪) : ১৮

আর এই প্রশ্ন যে, দুনিয়াতে মুরতাদের শাস্তি কী, এর জবাব তো সুস্পষ্টই। মুরতাদ যেহেতু আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে যুদ্ধ ঘোষণাকারী ও ভূপৃষ্ঠে অনাচার বিস্তারকারী এজন্য তার শাস্তি মৃতুদন্ড, যা কার্যকর করা সরকারের উপর ফরয।

إِنَّمَا جَزَاءُ الَّذِينَ يُحَارِبُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَسْعَوْنَ فِي الْأَرْضِ فَسَادًا أَنْ يُقَتَّلُوا أَوْ يُصَلَّبُوا أَوْ تُقَطَّعَ أَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُمْ مِنْ خِلَافٍ أَوْ يُنْفَوْا مِنَ الْأَرْضِ ذَلِكَ لَهُمْ خِزْيٌ فِي الدُّنْيَا وَلَهُمْ فِي الْآَخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ l إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا مِنْ قَبْلِ أَنْ تَقْدِرُوا عَلَيْهِمْ فَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ

যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কার্য করে বেড়ায় এটাই তাদের শাস্তি যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শুলে চড়ানো হবে অথবা বিপরীত দিক হতে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদের দেশ হতে নির্বাসিত করা হবে। দুনিয়াতে এটাই তাদের লাঞ্ছনা ও পরকালে তাদের জন্য মহাশাস্তি রয়েছে। * তবে, তোমাদের আয়ত্তাধীনে আসার পূর্বে যারা তাওবা করবে তাদের জন্য নয়। সুতরাং জেনে রাখ যে, আল্লাহ অবশ্যই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।-আল মাইদা ৫ : ৩৩-৩৪

আর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

من بدل دينه فاقتلوه

অর্থাৎ, যে তার ধর্ম (ইসলাম) পরিবর্তন করে তাকে হত্যা কর।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৯২২

অন্য হাদীসে আছে, একবার মুয়ায রা. আবু মূসা আশআরী রা.-এর সাথে সাক্ষাত করতে এলেন, (তাঁরা উভয়ে ঐ সময় ইয়ামানে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ হতে দায়িত্বশীল হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন) মুয়ায রা. দেখলেন, এক লোককে তার কাছে বেঁধে রাখা হয়েছে। জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার? আবু মূসা আশআরী রা. বললেন, এ লোক ইহুদী ছিল, ইসলাম গ্রহণ করেছিল, আবার ইহুদী হয়ে গেছে। আপনি বসুন। মুয়ায  রা. বললেন, একে হত্যা করার আগ পর্যন্ত আমি বসব না। এটিই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফয়সালা। তিনি একথা তিনবার বললেন। সেমতে ঐ মুরতাদকে হত্যা করা হল।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৯২৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস :   ১৭৩৩

বিশেষত যে নাস্তিক বা মুরতাদ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে কটূক্তি করে কিংবা ইসলামের নিদর্শনের অবমাননা করে সে তো সরাসরি ‘মুফসিদ ফিল আরদ’’ (ভূপৃষ্ঠে দুষ্কৃতিকারী)। এ ব্যক্তি রাসূল অবমাননাকারী হিসেবেও ‘‘ওয়াজিবুল কতল’’ (অপরিহার্যভাবে হত্যাযোগ্য) এবং দুষ্কৃতিকারী হিসেবেও।

একারণে প্রত্যেক মুসলিম জনপদের দায়িত্বশীলদের উপর ফরয, উপরোক্ত দন্ড কার্যকর করে নিজেদের ঈমানের পরিচয় দেয়া। যেখানে এ আইন নেই তাদের কর্তব্য, অবিলম্বে এই আইন প্রণয়ন করে তা কার্যকর করা, যদি তারা আখিরাতের কল্যাণ চান।

তারা যদি এই সৎসাহস করেন তবে তা তাদের ‘মসনদে’র জন্যও উত্তম। নতুবা মনে রাখতে হবে, যাদের নারাজির ভয়ে তারা এইসব দন্ড কার্যকর করা থেকে বিমুখতা প্রদর্শন করছেন তারা না তাদের মসনদ রক্ষা করতে পারবেন, না আখিরাতের কঠিন পাকড়াও থেকে মুক্ত করতে পারবে, আর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফায়াত থেকে বঞ্চিত হওয়া তো অনিবার্য-ই।

 

১৩. ঈমানের সবচেয়ে বড় রোকন তাওহীদ, শিরক মিশ্রিত ঈমান আল্লাহর কাছে ঈমানই নয়

ঈমানের সর্বপ্রথম রোকন হচ্ছে ‘ঈমান-বিল্লাহ’ (আল্লাহর উপর ঈমান)। আর ঈমান বিল্লাহর প্রথম কথা হচ্ছে, আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব স্বীকার করা, একমাত্র তাঁকেই ‘রব’ ও সত্য মাবুদ বলে মানা, রুবুবিয়্যত ও উলূহিয়্যতের বিষয়ে তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করা। একমাত্র আলিমুল গাইব, হাজির-নাজির, মুখতারে কুল (সব বিষয়ে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী), মুশকিল কুশা (সংকট মোচনকারী) বিপদাপদে তাঁকেই ত্রাণকারী মনে করবে। তাঁর বিশেষ হক ও একান্ত বৈশিষ্ট্যসমূহে কাউকে শরীক করবে না। সাধারণ কার্যকারণ ও উপায়-উপকরণের উর্ধ্বের বিষয়ে আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে না। দৃঢ় বিশ্বাস রাখবে যে, জীবন-মৃত্যু, উপকার-অপকার, সুস্থতা ও নিরাপত্তা একমাত্র তাঁরই হাতে। তিনিই তা দান করেন। রিযিকদাতা একমাত্র তিনি। গোটা জগতের এক, অদ্বিতীয় স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রকও তিনিই। শরীয়ত দান ও হালাল-হারাম নির্ধারণ তাঁরই অধিকার। এতে কাউকে শরীক করবে না- না কোনো ইজম বা মতবাদকে, না কোনো নেতা বা দলকে, না রাষ্ট্র বা সম্প্রদায়কে। মোটকথা, তাওহীদকে পূর্ণরূপে ধারণ করা ও শিরক থেকে পুরাপুরি বেঁচে থাকা ঈমানের সবচেয়ে বড় রোকন। আল্লাহ তাআলার কাছে মুশরিকের ঈমান ঈমানই নয়। মুশরিককে তিনি কখনো মাফ করেন না।

মুশরিকের বিষয়ে আল্লাহ তাআলার অভিযোগ তো এটাই যে, সে ঈমানের সাথে শিরক মিশ্রিত করে।

وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُونَ l أَفَأَمِنُوا أَنْ تَأْتِيَهُمْ غَاشِيَةٌ مِنْ عَذَابِ اللَّهِ أَوْ تَأْتِيَهُمُ السَّاعَةُ بَغْتَةً وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ l قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ

* তাদের অধিকাংশ আল্লাহ্য় বিশ্বাস করে, কিন্তু তাঁর শরীক করে। * তবে কি তারা আল্লাহর সর্বগ্রাসী শাস্তি থেকে অথবা তাদের অজ্ঞাতসারে কিয়ামতের আকস্মিক উপস্থিতি থেকে নিরাপদ?

* বল, ‘এটাই আমার পথ : আল্লাহর প্রতি মানুষকে আমি আহবান করি সজ্ঞানে-আমি এবং আমার অনুসারীগণও। আল্লাহ্ মহিমান্বিত এবং যারা আল্লাহর শরীক করে আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নই।’-ইউসুফ (১২) : ১০৬-১০৮

আল্লাহ তাআলার দাবি সবসময় এটাই ছিল এবং কিয়ামত পর্যন্ত এটাই থাকবে যে, ‘আল্লাহর প্রতি ঈমান যেন’ খাঁটি তাওহীদের সাথে হয় এবং সব ধরনের শিরকের মিশ্রণ থেকে পাক সাফ হয়। কিছু আয়াত দেখুন :

قُلْ إِنِّي أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللَّهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّينَ l وَأُمِرْتُ لِأَنْ أَكُونَ أَوَّلَ الْمُسْلِمِينَ

* বল, ‘আমি তো আদিষ্ট হয়েছি, আল্লাহর আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে তাঁর ‘ইবাদত করার; * আর আদিষ্ট হয়েছি, আমি যেন আত্মসমর্পণকারীদের অগ্রণী হই।’-আযযুমার (৩৯) : ১১-১২

أَمِ اتَّخَذُوا آَلِهَةً مِنَ الْأَرْضِ هُمْ يُنْشِرُونَ l لَوْ كَانَ فِيهِمَا آَلِهَةٌ إِلَّا اللَّهُ لَفَسَدَتَا فَسُبْحَانَ اللَّهِ رَبِّ الْعَرْشِ عَمَّا يَصِفُونَ l لَا يُسْأَلُ عَمَّا يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْأَلُونَ l أَمِ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ آَلِهَةً قُلْ هَاتُوا بُرْهَانَكُمْ هَذَا ذِكْرُ مَنْ مَعِيَ وَذِكْرُ مَنْ قَبْلِي بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ الْحَقَّ فَهُمْ مُعْرِضُونَ l وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ

* তারা মৃত্তিকা থেকে তৈরি যেসব দেবতা গ্রহণ করেছে সেগুলো কি মৃতকে জীবিত করতে সক্ষম? * যদি আল্লাহ ব্যতীত বহু ইলাহ থাকত আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে, তবে উভয়ই ধ্বংস হয়ে যেত। অতএব তারা যা বলে তা থেকে ‘আরশের অধিপতি আল্লাহ পবিত্র, মহান। * তিনি যা করেন সে বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা যাবে না; বরং তাদেরকেই প্রশ্ন করা হবে। * তারা কি তাঁকে ছাড়া বহু ইলাহ গ্রহণ করেছে? বল, ‘তোমরা তোমাদের প্রমাণ উপস্থিত কর। এটাই, আমার সাথে যারা আছে তাদের জন্য উপদেশ এবং এটাই উপদেশ ছিল আমার পূর্ববর্তীদের জন্য।’ কিন্তু তাদের অধিকাংশই প্রকৃত সত্য জানে না, ফলে তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। * আমি তোমার পূর্বে এমন কোনো রাসূল প্রেরণ করিনি তার প্রতি এই ওহী ছাড়া যে, ‘আমি ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ্ নেই; সুতরাং আমারই ‘ইবাদত কর।’-আল আম্বিয়া (২১) : ২১-২৫

وَمَا تَفَرَّقَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ إِلَّا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَةُ l وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ l إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ وَالْمُشْرِكِينَ فِي نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا أُولَئِكَ هُمْ شَرُّ الْبَرِيَّةِ

* যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিল তারা তো বিভক্ত হল তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর। * তারা তো আদিষ্ট  হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ‘ইবাদত করতে এবং সালাত কায়েম করতে ও যাকাত দিতে, এ-ই সঠিক দ্বীন। * কিতাবীদের মধ্যে যারা কুফরী করে তারা এবং মুশরিকরা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে; তারাই সৃষ্টির অধম।-আলবায়্যিনাহ (৯৮) : ৪-৬

اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَهًا وَاحِدًا لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ l يُرِيدُونَ أَنْ يُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَيَأْبَى اللَّهُ إِلَّا أَنْ يُتِمَّ نُورَهُ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ l هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ

* তারা আল্লাহ ছাড়া তাদের পন্ডিতগণকে ও সংসার-বিরাগীগণকে তাদের প্রভুরূপে গ্রহণ করেছে এবং মারইয়াম-তনয় মসীহকেও। কিন্তু তারা এক ইলাহের ‘ইবাদত করার জন্যই আদিষ্ট হয়েছিল। তিনি ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই। তারা যাকে শরীক করে তা থেকে তিনি কত পবিত্র! * তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর জ্যোতি নিভিয়ে দিতে চায়। কাফিরগণ অপ্রীতিকর মনে করলেও আল্লাহ তাঁর জ্যোতির পূর্ণ উদ্ভাসন ছাড়া অন্য কিছু চান না। * মুশরিকরা অপ্রীতিকর মনে করলেও অন্য সকল দ্বীনের উপর জয়যুক্ত করার জন্য তিনিই পথনির্দেশ ও সত্য দ্বীনসহ তাঁর রাসূল পাঠিয়েছেন।-আত তাওবা (৯) : ৩১-৩৩

আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা হারাম। এর দ্বারা ঈমান নষ্ট হয়ে যায় এবং মানুষ কাফির ও মুশরিক হয়ে যায়। তা সে পাথর বা মূর্তিকে শরীক করুক কিংবা জিন্ন ও শয়তানকে করুক; অথবা ফেরেশতাদেরকে করুক, কিংবা কোনো নবী ও রাসূলকে শরীক করুক, যাঁদেরকে আল্লাহ তাআলা পাঠিয়েছেন তাওহীদ গ্রহণ ও শিরক বর্জনের পয়গাম দিয়ে। কিংবা এমন কোনো আলিম ও বুযুর্গকে শরীক করুক, যিনি জীবনভর মানুষকে তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন, কিংবা এমন কোনো নেতা ও গুরুকে শরীক করুক, যে কথা ও কাজের দ্বারা মানুষকে তাওহীদ থেকে নিবৃত্ত রেখেছে। সর্বাবস্থায় শিরক শিরকই বটে আর এতে লিপ্ত ব্যক্তি আল্লাহর দুশমন ও বিদ্রোহী কাফির ও মুশরিক।

কুরআন হাকীমে সব প্রকারের শিরক প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং সকল শ্রেণীর মুশরিককে জাহান্নামের হুঁশিয়ারি শোনানো হয়েছে।

(তরজমা) হে বনী আদম! আমি কি তোমাদের নির্দেশ দিই নাই যে, তোমরা শয়তানের দাসত্ব করো না, কারণ সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু?

* আর আমারই ইবাদত কর, এটাই সরল পথ।-ইয়া সীন (৩৬) : ৬০-৬১

قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنْ كُنْتُمْ فِي شَكٍّ مِنْ دِينِي فَلَا أَعْبُدُ الَّذِينَ تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلَكِنْ أَعْبُدُ اللَّهَ الَّذِي يَتَوَفَّاكُمْ وَأُمِرْتُ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ l وَأَنْ أَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا وَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُشْرِكِينَ l وَلَا تَدْعُ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنْفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَ فَإِنْ فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِنَ الظَّالِمِينَ l وَإِنْ يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ وَإِنْ يُرِدْكَ بِخَيْرٍ فَلَا رَادَّ لِفَضْلِهِ يُصِيبُ بِهِ مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَهُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ

(তরজমা) বল, হে মানুষ! তোমরা যদি আমার দ্বীনের প্রতি সংশয়যুক্ত হও তবে জেনে রাখ তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদের ইবাদত কর আমি তাদের ইবাদত করি না। পরন্তু আমি ইবাদত করি আল্লাহর যিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটান এবং আমি মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য আদিষ্ট হয়েছি।

(আমাকে আরও আদেশ দেয়া হয়েছে যে,) তুমি একনিষ্ঠভাবে দ্বীনে প্রতিষ্ঠিত হও এবং কখনই মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না, এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকেও ডাকবে না, যা তোমার উপকারও করে না, অপকারও করে না, কারণ তা করলে তখন তুমি অবশ্যই জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।

এবং আল্লাহ তোমাকে ক্লেশ দিলে তিনি ছাড়া তা মোচনকারী আর কেউ নেই এবং আল্লাহ যদি তোমার মঙ্গল চান তবে তাঁর অনুগ্রহ রদ করবার কেউ নেই। তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তিনি মঙ্গল দান  করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।-সূরা ইউনুস (১০) ১০৪-১০৭

إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيمًا

* নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাঁর সাথে শরীক করা ক্ষমা করেন না। তা ছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন; এবং যে কেউ আল্লাহর শরীক করে সে এক মহাপাপ করে।-আন নিসা (৪) : ৪৮

স্বরণ রাখা উচিত, তাওহীদই হল ঐ বিষয় যার দাওয়াত নিয়ে সকল নবী রাসূলকে আল্লাহ পাঠিয়েছেন, সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও এই তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্যই পাঠিয়েছেন। তাঁর উম্মতেরও এটাই দায়িত্ব। রিব’য়ী ইবনে আমের রা.সহ অন্যান্য সাহাবীদের ভাষায়-

الله ابتعثنا لنخرج من شاء من عبادة العباد إلى عبادة الله ومن ضيق الدنيا إلى سعتها، ومن جور الأديان إلى عدل الإسلام.

অর্থাৎ আল্লাহ আমাদের প্রেরণ করেছেন আল্লাহর বান্দাদেরকে বান্দার গোলামী থেকে মুক্ত করে আল্লাহর ইবাদতে দাখেল করতে। দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে তার প্রশস্ততার দিকে নিয়ে যেতে এবং সকল ধর্মের জুলুম থেকে মুক্ত করে ইসলামের ইনসাফের ছায়াতলে নিয়ে আসতে।

চলবে ইনশা-আল্লাহ…………..

আরো পড়ুন পোস্ট করেছেন

Comments

লোড হচ্ছে...
শেয়ার হয়েছে