আশুরার রোজা : গোনাহ মাফের সুবর্ণ সুযোগ

নূরুল্লাহ মারূফ

একটি নতুন বছর, কিছু নতুন স্বপ্ন। একটি নতুন হিজরী, নতুন কিছু ইতিহাসের সূচনা। প্রতিটি বছরই তাই আমাদের জন্য বয়ে নিয়ে আসে নতুন কিছু স্বপ্ন আর ইতিহাস, তেমনি আবার কিছু তৈরি হয়ে থাকে আগে থেকেই। বছরের নির্ধারিত সে সময়টা এলে শুধু যেগুলোর স্মৃতি নতুন করে আবার জাগরুক হয়ে ওঠে মাত্র। পৃথিবী ও তার বাসিন্দারা যে সময়গুলোতে দেখেছে ইতিহাস বিখ্যাত কিছু অবিস্মরণীয় ঘটনা। যার আবর্তন এবং বর্ণায়ন ভূমিকা রাখে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছুর।

নতুন বছরের এ প্রভাব পড়ে মানব জীবনেও। ক্যালেণ্ডারের তারিখগুলো চিহ্নিত হয়ে ওঠে তাই নতুন নতুন প্লান-প্রোগ্রামে। নির্ধারিত কিছু দিনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় অনেক কাজকর্মই। তেমনি হিজরী বছরও। যার প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ মাস মুহাররম। তবে এটি যে শুধু হিজরীর প্রথম মাস হিসেবেই তাৎপর্যপূর্ণ তা কিন্তু নয়, বরং এ মাসের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে ইসলামী ইতিহাসের এমন অসংখ্য ঘটনাবলী এবং সংঘটিত হয়েছে এমন আরো জীবন্ত কাহিনীও যা মানুষের হৃদয়ে আলোড়ন তুলে দীপ্ত করে ঈমানী চেতনা। তাই রাসুল সা. বরাবরই এ মাসের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন এবং দিয়েছেন এ মাসে রোজা পালনের প্রতি বেশ উৎসাহও। যার প্রমাণ বহন করে রাসূলের হাদিসসমূহ। তবে এখানে খেয়াল রাখতে হবে, আশুরা উপলক্ষে একমাত্র রোজা পালন ছাড়া ‘লৌকিক শোক পালন’ ও অন্যান্য ‘সামাজিক এবাদত’- সবই কিন্তু বিদআত। তাই এদিনে অন্য যে কোনও ধরনের লোক দেখানো সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান ও মাহফিলের আয়োজন থেকে বিরত থাকাটা অবশ্য বাঞ্চনীয়। নিম্নে আশুরার রোজার কিছু অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হলো।

আশুরার রোজার গুরুত্ব:
হযরত আবু হুরাইরা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেন, ‘রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হলো মহররমের রোজা (আশুরার রোজা) এবং ফরজ নামাজের পর সর্বোত্তম নামাজ হলো নফল নামাজ (তাহাজ্জুদ নামাজ)।’ (মুসলিম-২০৩৯)।

আশুরার রোজা হলো মুসা আ: এর অনুকরণ:
ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী কারীম সা. যখন মদিনায় এলেন তখন দেখলেন ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা রোজা রাখ কেন? তারা বলল: এটি উত্তম দিন। এ দিনে আল্লাহ বনি ইসরাঈলকে তাদের শত্রুর হাত থেকে মুক্ত করেছেন; তাই মুসা আলাইহিস সালাম এ দিনে রোজা রাখতেন। নবী সা. তখন বললেন: তোমাদের চেয়ে মুসার অধিক নিকটবর্তী আমি । অত:পর তিনি এ দিন রোজা রাখলেন এবং অন্যদেরকেও রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন।”
মুসলিম শরীফে এসেছে- “এটি মহান দিন। এদিনে আল্লাহ মুসাকে ও তাঁর কওমকে মুক্ত করেছেন এবং ফেরাউন ও তার কওমকে ডুবিয়ে মেরেছেন।” এবং মুসলিম শরীফের রেওয়ায়েতে আরেকটু বেশি আছে যে “…আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ; তাই আমরা এ দিনে রোজা রাখি”। বুখারির অন্য রেওয়ায়েতে এসেছে- “এ দিনের মহান মর্যাদার কারণে আমরা রোজা রাখি”। বুখারি শরীফেও অন্য রেওয়ায়েতে আরেকটু বেশি এসেছে- …“তিনি তাঁর সাহাবীদেরকে বললেন: তোমরা তাদের চেয়ে মুসার অধিক নিকটবর্তী। সুতরাং তোমরা রোজা রাখ”।

আশুরার রোজা গুনাহ মোচনকারী:
আশুরার রোজা বিগত বছরের গুনাহ মোচন করে দেয়।

নবী কারীম সা. বলেছেন, “আমি আল্লাহর নিকট প্রতিদান প্রত্যাশা করছি আরাফার রোজা বিগত বছর ও আগত বছরের গুনাহ মার্জনা করবে। আরও প্রত্যাশা করছি আশুরার রোজা বিগত বছরের সকল গুনাহ মার্জনা করে দিবে।” (সহিহ মুসলিম-১১৬২)।

এটি নিঃসন্দেহে আমাদের উপর আল্লাহ তাআলার অসামান্য অনুগ্রহ। অপর হাদিসে হযরত আবু কাতাদাহ রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সা. কে আশুরার রোজা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন: “বিগত এক বছরের গুণাহের কাফফারা হিসেবে গৃহীত হয়।” মুসলিম ও তিরমিজী।
তবে মনে রাখতে হবে, গুনাহ মাফ হবে কিন্তু কেবল সগিরা গুনাহই। কবিরা গুনাহ না। তবে যদি সগিরা বা কবিরা কোন গুনাহই না থাকে তাহলে তার আমলনামায় নেকি লেখা হবে এবং তার মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। আর যদি তার শুধু কবিরা গুনাহ থাকে, কোনও সগিরা গুনাহই না থাকে তাহলে তার কবিরা গুনাহকে কিছুটা হালকা করার আশা রাখতে পারি আমরা। (আল-মাজমু শারহুল মুহাযযাব, খ–৬)।

আশুরার রোজার জন্য রাসূলের প্রতীক্ষা:
আশুরার রোজার মহান মর্যাদার কারণে নবী সা. এ রোজার ব্যাপারে খুব আগ্রহী থাকতেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: “ফজিলতপূর্ণ দিন হিসেবে আশুরার রোজা ও এ মাসের রোজা অর্থাৎ রমজানের রোজার ব্যাপারে নবী সা. কে যত বেশি আগ্রহী দেখেছি অন্য রোজার ব্যাপারে তদ্রুপ দেখিনি।” (সহিহ বুখারি-১৮৬৭)।
উল্লেখ্য, হাদিসে يتحرى শব্দের অর্থ- সওয়াব প্রাপ্তি ও আগ্রহের কারণে তিনি এ রোজার প্রতীক্ষায় থাকতেন।

সুতরাং আমাদের উচিত আশুরার দিনটিকে হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী নিরঙ্কুশ রোজা ও ইবাদত বন্দেগীতে অতিবাহিত করা এবং আল্লাহর কাছে গোনাহ মাফের দোয়া চাওয়া। যেহেতু এদিনের একটি রোজাই মাত্র আমার বিগত এক বছরের সব সগিরা গোনাহের কাফফারা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। আর সেইসাথে বর্জন করা উচিত অন্যান্য লোক দেখানো মহা আড়ম্ভরপূর্ণ(!) শোক পালনের আচার অনুষ্ঠানগুলোও। আল্লাহ আমাদের গোনাহ মাফের এ সুযোগকে পুরোপুরিভাবে কাজে লাগানোর তাওফিক দান করুন। আমিন।

আরো পড়ুন পোস্ট করেছেন

Comments

লোড হচ্ছে...
শেয়ার হয়েছে