হলি লাইফ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র – একই সাথে একটি দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

লেখক: শায়েখ ইউসুফ সুলতান।

জুমার পর প্রশ্নোত্তর পর্বে অনেক নতুন বিষয় জানার সুযোগ হয়। আজ এক ভাইয়ের এক প্রশ্নের ভেতর দিয়ে জানলাম, তিনি একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে কর্মরত আছেন। আগ্রহ থেকে আরো জানার চেষ্টা করলাম। জানতে পারলাম, এখানে মাদকাসক্ত ভাইদের তাবলীগের সিলেবাসে নিরাময়ের চেষ্টা করা হয়। সবাই নামায, কুরআন, দাড়িতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেন। আগ্রহ আরো বাড়ল। জানতে চাইলাম, তাদের নিরাময় কেন্দ্রটা কোথায়, আমি যেতে চাই।

যাহোক, এরপর একসঙ্গে বের হলাম। অবাক ব্যাপার হলো, মসজিদের উল্টো পাশেই মূল সড়কেই তাদের অবস্থান। হলি লাইফ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র। প্রায় দশ বছর আগে তাদের যাত্রা শুরু হয়। দুর্ভাগ্য আমার, আগে কখনো তাদের ব্যাপারে শুনি নি।

এখানে মাদকাসক্ত ভাইদেরকে তাদের পরিবার দিয়ে যান। চার মাস থাকতে হয়। মনোরোগ চিকিৎসক, অভিজ্ঞ ডাক্তার ও আলেমদের সমন্বয়ে তাদের টিম। ভর্তি হয়ে প্রথম দিকে কিছু উগ্রতা থাকলেও খুব দ্রুত তাদের পরিবেশের সাথে সবাই খাপ খেয়ে যায়। পর্যায়ক্রমে ওযু, গোসল, নামায, রোজা ইত্যাদির নিয়ম ও বিধান শেখানো হয়। কুরআন শরীফ পড়ানো হয়। তাবলীগের পদ্ধতিতে দিনের কর্মপদ্ধতি সাজানো হয়।

আমরা যখন গিয়েছি, তখন ওপরে জুমার নামায চলছে। এই ফাঁকে রোগীদের থাকার জায়গাটা দেখে নিলাম। চমৎকার পরিবেশ, মনে হবে উন্নত কোনো মাদ্রাসা। চারপাশে পাঞ্জাবী, দ্বীনী বইয়ের সেলফ, জায়নামাজ বিছানো – ইত্যাদি। নামায শেষে একে একে তারা আসলেন। দেখে বুঝার উপায় নেই, কে স্টাফ আর কে রোগী। সবার মুখে লম্বা দাড়ি, পাঞ্জাবী, টুপি – মাশা’আল্লাহ।

জানতে পারলাম, এখান থেকে যারা বের হন, প্রায় সবাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যান। অনেকেই তাবলীগের সাথে সম্পর্ক রাখেন। কেউ কেউ আবার বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে মাদকাসক্তিতে ফিরে যান, তবে এদের সংখ্যা খুব বেশি নয়।

যে ভাইয়ের মাধ্যমে গেলাম, তার থেকে জানতে পেরেছি, অধিকাংশই হাই-সোসাইটির বাসিন্দা ছিলেন। পড়েছেন ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে। পরিবার অত্যন্ত ধনী। কেউ হারাম প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, কেউ বা বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে, আবার কেউ সংসারের টানাপড়েনে, কেউ বা ব্যবসায় ব্যর্থতার কারণে নিরাশ হয়ে মাদকাসক্ত হয়েছেন।

কথা বলতে বলতেই টেবিলের ওপর গ্লাসের নিচে রাখা একটি সাক্ষাৎকারে চোখ গেল। কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জনাব মাঈনুদ্দীন সাহেবের সাক্ষাৎকার। তিনি বলেছেন, দশ বছর আগে পরিবারের এক আত্মীয়ের ছেলে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। একজন সদস্যের মাদকাসক্তির কারণে কীভাবে একটি পরিবার ভেঙে যায় তা তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। সেই ছেলেকে নিরাময়ের ব্যাপারে তাকে অনেক দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে।

তিনি দেখেছেন, নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে রোগীদের সিগারেটের সুযোগ দেয়া হয়, বা ডিশ চ্যানেল দেখার সুযোগ দেয়া হয়। জানতে চাইলে কর্তৃপক্ষ বলতেন, ইনজেকশন দিয়ে আর কত ঘুম পাড়িয়ে রাখবে, একটু-আধটু এসব না দিলে হয় না।

তিনি ভাবলেন, জনাব রাসূলুল্লাহ স. এসেছিলেন মাদকাসক্ত নারীলোলুপ এক জাহেলী সমাজে। সেই সমাজ তাঁর সাহচর্যে পরিণত হয় সোনার মানুষে, জগতশ্রেষ্ঠ সাহাবায়ে কিরামে রা.। আজও তো কুরআনের সে শক্তি আছে, হাদীসের সে প্রাণ আছে, তবে আজ কেন তাদেরকে কুরআন-হাদীসের সংস্পর্শ দেয়া হবে না। তাছাড়া নৈরাশ্য কাটতে পারে একমাত্র স্রষ্টার ইবাদতে, তাঁকে চেনার মধ্য দিয়ে। কাজেই তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো পন্থায় প্রকৃত নিরাময় সম্ভব নয়। সেই থেকেই হলি লাইফের পথচলা।

জুমার নামায পড়ে ওপর তলা থেকে মাঈনু্দ্দীন সাহেব একটু দেরি করে আসলেন। স্টাফদের মুখে তার অনেক প্রশংসা শুনলাম। বাংলার সিংহপুরুষ জনাব হাফিজ্জী হুজুর রহ. থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত অসংখ্য উলামায়ে কিরামের সাহচর্য পেয়েছেন তিনি।

দেখা হতেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসল। আসলে দ্বীনের খিদমাহ যারা করেন, চেহারায় একরকম প্রফুল্লতার নূর দেখা যায়। একটু পরই জুব্বা পড়া একজন আলেম আসলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন, তাঁর সন্তান, মাওলানা আয়ায, হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে ফারিগ। তাঁর তিন ছেলে, সবাই মাশা’আল্লাহ আলেম।

মাঈনুদ্দীন সাহেব বললেন, ওপরে গিয়েছেন? কলিজা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে ইনশা’আল্লাহ। বললাম, ওপরে যাই নি, তবে এই তলাতে যা দেখেছি, কলিজা বেশ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে আলহামদুলিল্লাহ।

অফিসের একপাশে সেলফে অনেকগুলো পুরস্কার। জাতীয়-আন্তর্জাতিক পুরস্কার দিয়ে সেলফগুলো পূর্ণ। জানলাম, আরো অনেক পুরস্কার রাখার জায়গা নেই, বাক্সবন্দী হয়ে আছে।

একটু তাড়া থাকায় বিদায় নিয়ে আসতে চাইলাম। যে ভাই নিয়ে গেলেন, তিনি আসতে দিলেন না। সবার সাথে বসে খেয়েই আসতে হলো। বিরানি আর বোরহানি। বিদায় নেয়ার কালে সবাইকে এই খিদমাহর জন্য অসংখ্য শুকরিয়া জানিয়ে আসলাম। আশাবাদ ব্যক্ত করলাম, আপনাদের পাশে থেকে জান্নাতে যাওয়ার সৌভাগ্যও যদি হয়, আলহামদুলিল্লাহ।

আল্লাহ আমাদেরকে নানা ভাবে দ্বীনের খিদমায় অংশ নেয়ার তাওফীক দিন। আমীন।

===

সহজ ঠিকানা: মালিবাগ রেইলগেইট সুপারমার্কেটের ঠিক উল্টো দিকে, রাস্তার পশ্চিম পাশে মেইন রোডেই, অগ্রণী ব্যাংকের ওপরে ৪র্থ, ৫ম ও ৬ষ্ঠ তলা। হলি লাইফের ব্যানার আছে বিল্ডিংয়ে।

আরো পড়ুন পোস্ট করেছেন

Comments

লোড হচ্ছে...
শেয়ার হয়েছে