গল্প : জলমগ্ন

সুলতান আবদুর রহমান

আশরাফ ভিজে জুবুথুবু হয়ে গেছে। ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছে সে। খুব শীত করছে। মাথায় পলিথিন প্যাঁচানো, নামে মাত্র। চুল চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি পড়ছে। ফোঁটা ফোঁটা। পাঞ্জাবি গায়ের সাথে সেঁটে গেছে একেবারে। পায়জামা হাঁটুর নিচ পর্যন্ত গোটানো ছিলো, তবুও ভিজে গেছে। সে কোন রকমে বাঁচিয়ে রেখেছে পত্রিকাগুলি। ছোট একটা পলিথিন দিয়ে ঢেকে। নিজে ভিজলেও, যে করেই হোক, বৃষ্টি থেকে এগুলিকে বাঁচাতে হবে।

কাল রাত থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। মুষলধারে। সাথে দমকা বাতাস বইছে। ভোরের দিকে বৃষ্টি কিছুটা কমে এখন আবার বেড়েছে। এ রকম চলতে থাকলে কপালে দুঃখই আছে আজ। এখনো পাঁচটা পত্রিকাও বেচতে পারে নি। অথচ সময়ও বসে নেই। সাড়ে ন’টা বেজে গেছে প্রায়। এ সময়ের পরে সাধারণত কম বিক্রি হয়। সবগুলি কাগজ বিক্রি না হলে খুব লস হবে। স্যাঁতস্যাঁতে পত্রিকা ফেরত নাও নিতে পারে। তখন হাত একদম খালি হয়ে যাবে। পরের দিনের পত্রিকা কেনার পুঁজি থাকবে না। আশরাফ দাঁড়িয়ে আছে। মজিবর চাচার দোকানের সামনে। মরচে পড়া, চা-ছাকনির মতো ফুটো টিনের নিচে। সে মনে মনে ভাবছে, কি করা যায়!

দোকানটি হাইওয়ের পাশেই। আনন্দ-কাউন্টারের অপর সাইডে। একটু দূরে। টঙ্ তোলা দোকান। তেমন বড়ো না। ছোট-খাটো। চা-পান-বিস্কুট-কেক-বনরুটি, এ সব বিক্রি হয়। মজিবর চাচার প্রতিবেশি আশরাফ। পাশাপাশি ঘর। আশরাফের বাবা মারা যান বছর দুই হলো। পঞ্চবটি রুটে রিক্সা চালাতেন। বছর দু’এক আগে মাসখানেকের মতো টাইফয়েড জ্বরে ভোগেন। তারপর একদিন, বলা নেই কওয়া নেই, মানুষটা মরে যায়।

শান্তিনগর বস্তিতে আশরাফদের ঘর। বাবা মারা যাবার পর থেকে এখানে আছে। আগে রাজবাড়ি কলনিতে থাকতো। মোটামুটি ভালোই ছিলো। অভাব থাকলেও সুখ ছিলো। এখন সে অবস্থাও নেই। দিন এনেও দিন চলে না। নুনে পান্তায় সকাল সন্ধা। রাত্রি কাটে উপোষে।

আশরাফ মাদ্রসার ছাত্র। হেফজখানায় পড়ে। হাজী শরিয়তুল্লাহ হাফিজিয়া মাদরাসায় পড়ছে চার বছর হলো। মক্তব পড়লো দু’বছর। তারপর নাজেরা শেষ করে হেফজখানায়। আশরাফ ছাত্র হিসেবে মেধাবী এবং মনোযোগী। নিয়মিত সবক দেয়। এখন তেইশ পারা চলছে। ছোট দু’টি বোন আছে ওর। হাফসা আর সালমা। হাফসা মক্তবে পড়ে। চতুর্থ শ্রেণিতে এবার। আর সালমা এখনো ছোট। ঘরেই থাকে। সারাদিন নিজের মনে খেলা করে। হাফসার কাছে সন্ধ্যেবেলা অ-আ-ক-খ পড়তে বসে।

আশরাফের মা সেলাইর কাজ করতেন। ঘরে বসেই। “সুপ্তি টেইলার্স এন্ড ফ্যাশন” এর অর্ডারি কাজ। লেডিস আইটেমের। বাবা মারা যাবার পর থেকে তিনিই সংসার চালাচ্ছিলেন। যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার কোন মতো চলে যেত। আশরাফের বেতন, খোরাকির টাকা মাদরাসা কর্তৃপক্ষ মওকুফ করে দিয়েছে। বিশেষ বিবেচনায়। এতে মায়ের সুবিধেই হয়েছে। কিছুটা খরচ তো কমলো! কিন্তু গত দু’সপ্তাহ ধরে মা খুব অসুস্থ। রাতে কাঁপন দিয়ে জ্বর আসে। প্রচন্ডভাবে আসে। দিনেও জ্বর থাকে। তবে রাতের তুলনায় সামান্য। তবুও কোন কাজই করতে পারেন না। মেশিনে বসতে পারেন না। হাত কাঁপে। চোখে ঝাপসা দেখেন। এই সপ্তাহে কোন কাজই করেন নি। বিল হয় নি, তাই ঘরে কোন টাকা-পয়সাও নেই। গত সপ্তাহের বিল যা পেয়েছেন, ডাক্তারের ভিজিট, টেস্ট আর ওষুধেই সব শেষ।

আশরাফ বোর্ডিংয়ে থেকেই পড়াশোনা করে। মায়ের জ্বরের কথা শুনে তিন দিনের ছুটি নিয়ে বাসায় এসেছে। মাকে নিয়ে ডাক্তার-ডায়গোনেস্টিক সেন্টার দৌড়াদৌড়ি করেছে। এখন সেটাও সম্ভব না। ঘরে কানাকড়িও নেই আর। এদিকে মায়ের অসুখ বেড়েই চলেছে। ওষুধও প্রায় শেষ পর্যায়। মজিবর চাচার কাছ থেকে পাঁচ’শ টাকা কর্জ নিয়েছিলো আশরাফ। তাও ঘরের চাল আর হাফসার বেতনেই শেষ। আশরাফ আবার মজিবর চাচার কাছে যায়। মজিবর চাচারও আর্থিক অবস্থা শোচনীয়। এবার টাকা দিতে পারলেন না। হাত খালি। অথচ আশরাফের বাবা মারা যাবার পর তিনিই একমাত্র তাদের পাশে ছিলেন। সাহায্য করেছেন, সব সময়ে।

”চাচা, এখন কি করমু? ঘরে আর একটা টাকাও নাই। মায়ের জ্বর তো কমতাছে না। ওষুধ শ্যাষ।” কথাগুলি বলতে থাকে আশরাফ, কাঁদতে কাঁদতে, মজিবর চাচাকে।

কথা শুনে খুব মন খারাপ হয় মজিবর চাচার। কিন্তু কি করবেন। তারও তো হাত খালি এ সময়ে। তেমন কিছু না ভেবেই চাচা বলেন, ” আচ্ছা আশরাফ, তুই কিছু করনা! অন্তত তোর মায়ের ওষুধের ট্যকাটাতো হইবো! তোর মা সুস্থ হলে আমি সহ তোর মা গিয়া মাদরাসায় বইলা আসমুনে, ক্যান তুই এত দেরি করলি। চিন্তার কিছু নাই।”

“কি করমু চাচা? আফনে একটা কাম দিয়া দ্যান। আমি করমু।” চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে আশরাফ।

“এক কাজ কর, বাস স্ট্যান্ডে সকালে পতরিকা ব্যাছ। স্ট্যান্ডে বাস থামলেই বাসে উইঠা হকারি করবি। দশটা পর্যন্ত বেচলেই হইবো। এর মইদ্যেই সব বেচা হইয়া যাইবো, দেখিস।”

সে থেকে চারদিন হলো বাস স্ট্যান্ডে পত্রিকা বিক্রি করে আশরাফ। ফজরের নামাজ শেষে ১নং রেলগেটে যায়। মজিবর চাচার লিস্ট দিয়ে দেন, কোন কোন পত্রিকা কয়টা করে কিনতে হবে। সে অনুযায়ী পত্রিকা কিনে। তারপর সেখান থেকে এসে পঞ্চবটি স্ট্যান্ডে, বাসে বাসে পত্রিকা বিক্রি করে। যাত্রী ছাওনিতেও বিক্রি হয় কিছু।

গত তিনদিন ভালোই বিক্রি করেছে পত্রিকা। ক্রেতার চাহিদা দেখে গতকাল নির্ধারিত সংখ্যা থেকেও বেশি পত্রিকা এনেছে। শুধু বাসে নয়, কাউন্টারের অপেক্ষমাণ যাত্রী এবং পথচারীদের কাছেও পত্রিকা বিক্রি করেছে। কিন্তু আজ বৃষ্টির কারণে পত্রিকা বিক্রি হচ্ছে না। রাস্তা খালি। কাউন্টারে কেউ কিনছে না। বাসে গিয়েও বিক্রি করা যাচ্ছে না। যেখানে দাঁড়িয়েছে, সেখান থেকে বাসে যেতে যেতেই সব ভিজে যাবে।

আশরাফ ভাবতে থাকে, যদি পত্রিকা ভিজে যাওয়ার ভয়ে পত্রিকা বেঁচা না হয়, তবে অনেক টাকা লোকশান যাবে। আগামীকাল পত্রিকা কিনে বেঁচা যাবে না। মা এখন অনেকটাই সুস্থের দিকে। টাকা না হলে পুরাপুরি সুস্থ হওয়া পর্যন্ত ওষুধ খাওয়ানো যাবে না। তখন দেখা যাবে অসুখ আবার বেড়েছে। আবার ডাক্তার, ভিজিট, ওষুধ। আশরাফের বাবা’র কথা মনে পড়ে যায়। বুকটা ধক করে ওঠে। মনকে শক্ত করে আশরাফ। তাকে ভিজে ভিজে হলেও পত্রিকাগুলি বেচে শেষ করতে হবে।

ঐ তো, আনন্দ কাউন্টারে বাস এসে থেমেছে। ভালো করে পলিথিন দিয়ে পত্রিকা প্যাঁচায় আশরাফ। এক পাশে মুখ খোলা রাখে। পত্রিকা বের করার জন্য। বুকে শক্ত করে চেপে ধরে পত্রিকার বান্ডেল। তারপর বিসমিল্লাহ বলে দৌড় দেয়। বাসের দিকে। আর চিৎকার করে ডাকতে থাকে, পত্রিকা লন। পত্রিকা লন। ইত্তেফাক। ড্যান্ডিবার্তা। আলোকিত বাংলাদেশ।

আকাশ অন্ধকার হয়ে আসে। বিদ্যুৎ চমকায় মুহুর্মুহু। কোথাও প্রচণ্ড শব্দে বজ্রপাত হয়। সাথে তুমুল বর্ষণে নগরীর পিচ-ঢালা পথের বুকে রিমঝিমিয়ে নূপুর-ধ্বনি বাজতে থাকে। সে শব্দে আশরাফের হাঁক ঢাকা পড়ে যায়।

আরো পড়ুন পোস্ট করেছেন

Comments

লোড হচ্ছে...
শেয়ার হয়েছে